মধ্যযুগে সমগ্র ইউরোপ যখন অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত তখন স্পেনের মুসলিমরা গড়ে তুলেছিল জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ এক সাম্রাজ্যের। দক্ষিণ স্পেনের বিস্তৃত অঞ্চল ছিল এই সাম্রাজ্যের অধীনে। আরবেরা এই অঞ্চলের নামকরণ করেছিল আল-আন্দালুস। বর্তমান সময়ে এই অঞ্চলকে সবাই চেনে স্পেনের রাজ্য আন্দালুসিয়া হিসেবে।
আন্দালুসিয়া সমন্ধে আমি তেমন কিছুই জানতাম না। পাওলো কোয়েলহোর ফ্যান্টাসি উপন্যাস দ্যা আলকেমিস্ট বইয়ে এর কথা উল্লেখ থাকলেও আন্দালুসিরার ইতিহাস সমন্ধে আমার জ্ঞান শুন্যই ছিল বলা যায়।
তাই
এবারের ছুটিতে বেড়াতে যাব বলে গন্তব্য হিসেবে যখন স্পেনের এই প্রদেশকে বেছে
নিলাম স্বাভাবিকভাবে আন্দালুসিয়ার কিছু ইতিহাস আগে থেকে জেনে নেওয়ার সুযোগ
হাতছাড়া করলাম না। বিভিন্ন উৎস থেকে আমি যে তথ্যগুলো জেনেছি সেটাই এই
লেখার বিষয়বস্তু।
আমার প্রশ্ন ছিল স্পেনে মুসলিমরা এসেছিল কিভাবে? আর
এসেছিলই যখন তারা সেখান থেকে হারিয়ে গেল কিভাবে? উল্লেখ্য, আধুনিক স্পেন
মূলত ক্যাথলিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত এবং এর জনসংখ্যার খুব ক্ষুদ্র অংশ
মুসলমান। কিন্তু সাতশ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর স্পেনের চেহারা ছিল আলাদা।
বিশেষ করে এর দক্ষিণাংস। আরবদের কৃতিত্বে আন্দালুসিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল ছিল
মুসলিমদের শাসনাধীন। সেখানে মুসলমান, ইহুদী ও খ্রীস্টান একে অপরের সাথে
সহাবস্থান করত এবং ধর্ম নিয়ে সেভাবে কোন রক্তারক্তি ছিল না।
স্পেনের মুসলিমরা এসেছিল মূলত উত্তর আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে। ছয়শ শতাব্দীতে মদীনায় মুসলিম সাম্রাজ্য পত্তনের পরপরই খুব দ্রুত সেই সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। একশ বছরের মধ্যেই তা সিরিয়া, মিসর এবং মরক্কোর উত্তরের অনেক অংশে বিস্তার লাভ করে। সিরিয়া ও মরক্কোর মুসলিমরা ভূমধ্যসাগর পার হয়ে স্পেনে প্রবেশ করলে সেখান থেকেই কালসুচনা হয় নতুন এক সভ্যতার। সেই সভ্যতা মোটেও ধর্মীয় গোঁড়ামি নির্ভর ছিল না। বরং গণিত, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের চর্চায় তারা ছিল এশিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য যেকোন অঞ্চলের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
আল-আন্দালুসের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কর্ডবা শহর। নবম – দশম শতকের দিকে মুসলিম শাসনামলে এই শহরে গড়ে ওঠে বড় বড় প্রাসাদ, অট্টালিকা এবং বাগান। সেসময় এই শহরের জনসংখ্যা এবং চাকচিক্য ছিল লন্ডনের থেকেও বেশি। কর্ডবার পাশাপাশি আর একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল গ্রেনাডা। এই শহর ছিল আল-আন্দালুসের সাংস্কৃতিক রাজধানী। সকল ধর্মের কবি, সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানীরা এখানে তাদের স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করত।
শিক্ষা-দীক্ষায় আল-আন্দালুস ছিল একদম আধুনিক। রাজা থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ সবাই শিক্ষা গ্রহণ করত। শিক্ষা মানে শুধু কোরান পরে তেলাওয়াত করা নয় বরং জীবনের উপযোগি প্রায়োগিক শিক্ষা। খ্রিস্টান সমাজে শুধু পাদ্রিরা জ্ঞানের চর্চা করত। কিন্তু আল-আন্দালুসে ধনী-গরীব সকলে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়। তাই খুব দ্রুতই এই অঞ্চল অনেক ধনী এবং সম্পদশালী হয়ে ওঠে। সেই ধন-সম্পদ ব্যবহার করেই তারা তাদের অবকাঠামো এবং সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রাখে।
বলা হয়ে যাকে, সাধারণ জীবনের সমস্যাগুলো আল-আন্দালুসের মানুষজন সমাধান করত গণিত ও যুক্তির দ্বারা। এর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা না গেলেই কেবল তারা ধর্ম গ্রন্থের আশ্রয় গ্রহণ করত।
স্পনের এই মুসলিমরা একদিকে যেমন আরব থেকে বয়ে আনা জ্ঞানের চর্চা করত, তেমনি তারা পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাও অব্যাহত রেখেছিল। তাদের কারণেই আরবের বিভিন্ন মনীষিদের কাজ ল্যাটিনে অনুবাদিত হয়। সেইসব অনুবাদের কারণে প্রাচীন গ্রীসের হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান আরব হয়ে আবার ইউরোপে ফিরে আসে। অক্সফোর্ডের লাইব্রেরীতে এমন আরবী থেকে ল্যাটিনে অনুবাদিত অনেক পান্ডুলিপি এখনও সংরক্ষিত আছে।
স্পেনের এই মুসলিম সভ্যতার হাত ধরেই ইউরোপে নবজাগরণ তথা রেনেসাঁর উদ্ভব হয়। সেখান থেকে আধুনিক ইউরোপের সূচনা। কিন্তু ইউরোপে আল-আন্দালুসের ভূমিকা কখনও সেভাবে স্বীকৃত হয়নি। সত্যিকার অর্থে মুসলিমরাও আল-আন্দালুসকে তার প্রাপ্য কৃতিত্বটি দেয় নি। দ্বাদশ শতাব্ধীতে উত্তর আফ্রিকা থেকে ফিরে এসে মুসলিমরা মনে করে আল-আন্দালুস এলাকার মানুষজন পথভ্রান্ত মুসলমান। তাদের মধ্যে ‘খাঁটি’ ইসলাম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তারা আল-আন্দালুস আক্রমণ করে। একদিকে দক্ষিণ থেকে আফ্রিকার মুসলিমদের আক্রমণ অন্যদিকে উত্তর থেকে ক্যাথলিকদের আক্রমণে আল-আন্দালুস ধীরে ধীরে দূর্বল হতে থাকে। চৌদ্দশ সালে সর্বশেষ গ্রেনাডার পতনের মাধ্যমে ইতিহাসে সমাপ্ত হয় আল-আন্দালুস নামক অধ্যায়ের। ক্যাথলিকরা সমগ্র স্পেনে পুনরায় রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে যা আজ অবধি বর্তমান।
এবারের স্পেন সফরে কর্ডবা এবং গ্রেনাডা এই দুই শহরেই ঘুরতে যাব। এই লেখাটি যখন লিখছি তখন আমি লন্ডন থেকে মালাগাগামী বিমানে। মালাগার পর গ্রেনাডা, কর্ডবা ঘুরে তারপর যাব সেভিয়ায়। সেভিয়া থেকে ফিরব অক্সফোর্ডে। দেখা যাক, আন্দালুসিয়া তথা আল-আন্দালুসে কি ধরণের এডভেজ্ঞার অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
- লন্ডন ও মালাগার মধ্যকার কোন এক জায়গায়
৩/১/২০১৯