যেমন ছিল আমার ২০১৯ঃ গবেষণা এবং জীবন

তিনটি শব্দে বছরটির সারসংক্ষেপ করতে গেলে যা দাঁড়ায় তা হলোঃ পুরোই দৌড়ের উপর।
গত জানুয়ারীতে আমস্টারডাম শহরের জমকালো আলোকসজ্জায় যখন নতুন বছরের উৎযাপন করছিলাম তখন বোঝার কোন উপায় ছিলনা কি অপেক্ষা করছে এ বছরে।

আমস্টারডাম - ব্রাসেলস ট্যুর শেষ করে অক্সফোর্ডে প্রথম দিন ল্যাবে গিয়ে পুরাতন ইমেইল ঘাটতে গিয়ে বুঝলাম একটা বিশেষ ইমেইল প্রথমবার পড়ার সময় বিশাল ভুল করে ফেলেছি। সেই ইমেইলটি ছিল একটা সম্মেলনের বিষয়ে।


ফেব্রুয়ারী মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমার গবেষণা নিয়ে একটা পোস্টার উপস্থাপন করার কথা। ভেবেছিলাম সান ডিয়োগের সম্মেলনের জন্য যে পোস্টারটা বানিয়েছিলাম সেটা দিয়েই কাজ চালিয়ে দিব। তাই নতুন করে আর পোস্টার বানানোর প্রয়োজন ছিল না।

কিন্তু ভাল করে ইমেইলটা পড়ার পরই বুঝলাম সেই পরিকল্পনায় গুরেবালি। পোস্টার নয় আমাকে ২০ মিনিট বক্তৃতা দিতে হবে। তাও আবার সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রাইম টাইমে। ঐ সময় অন্য কোন সেশন চলবে না। তাই হল ভর্তি শ্রোতা থাকবে।

বক্তৃতা এবং ডিজিটাল উপস্থাপনা তৈরির জন্য হাতে সময় আছে প্রায় চল্লিশ দিনের মত। সত্যি বলতে অনেক ডাটা এনালাইসিস করাও বাকি ছিল।

প্লান করলাম যেভাবেই হোক সবকিছু এই কম সময়ের মধ্যেই করে ফেলার। সেই অনুযায়ী প্রতিদিন কাজ করতে থাকলাম সকাল-সন্ধ্যা।

মাস শেষে কিভাবে কিভাবে যেন উপস্থাপনাটা দাঁড়িয়ে গেল।

এরপর উপস্থাপনাসহ বক্তৃতা অনুশীলনের পালা। কতবার যে ল্যাবের সামনে এবং একা একা প্রাকটিস করলাম। অনেক সংযোজন বিয়োজন হল। নিউ ইয়র্কগামী ফ্লাইটে বসেও সংযোজন বিয়োজনের কাজ করতে থাকলাম।

লন্ডন থেকে সরাসরি বাল্টিমোরের ফ্লাইট না নিয়ে নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট নেওয়ার কারণ হল - পথিমধ্যে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির এক বন্ধুর সাথে দেখা করা এবং নিউ ইয়র্কে কিছুটা ঘোরাঘুরি করা।

যাই হোক, গবেষণাকে সহজ ভাষায় অন্যের বোধগম্য করে ব্যাখ্যা করা সবসময়ই একটা চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে সেটা যখন হয় নতুন কোন থিওরী বা নতুন কোন ধারণা নিয়ে করা গবেষণা। অনেক সময় মাসের পর মাস চলে যায় নিজের গবেষণাকে ব্যাখ্যা করার ভাষা খুঁজে পেতে।

সম্মেলনে যে গবেষণাটি উপস্থাপন করেছিলাম তার বিষয় ছিল, মস্তিষ্কের শ্রবণ সংবেদী স্নায়ু কোষের ক্রিয়া থেকে প্রানী কোন শব্ধ শুনছে সেটা ডিকোড করা। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, স্নায়ু কোষের ক্রিয়ায় প্রানী যে শব্দ অতীতে শুনেছে তার তথ্য যেমন থাকে তেমনি ভবিষ্যতে যে শব্দ শোনার প্রত্যাশা করছে তার তথ্যও থাকে।

বাল্টিমোরে সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে একটা গবেষণাপত্রের রিভিশন করার কথা ছিল সুপারভাইজারের সাথে।

কিন্তু যতবারই হোটেল সুইটের লিভিং রুমে ওকে নিয়ে কাজ করতে বসি, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে বলে তার কাজে মন বসে না। এরপর সে তার রুমে গিয়ে ল্যাপটপে গান শোনা শুরু করে। কয়েকবার এমন হওয়ার পর আমি বেশ চটে গেলাম ওর উপর। তারপর ওকে বললাম আচ্ছা অক্সফোর্ডে ফিরে গিয়ে আমরা এই কাজ শেষ করব।

পরের কয়েকদিন সম্মেলনের সময় ওকে এভোয়েড করলাম। ডিনার খেতে যাইতে চাইলে বলি আমি একা ডিনার খাব। ঘুরতে গেলে সহপাঠী বন্ধুর সাথে ঘুরতে যাই কিন্তু সুপারভাইজরকে সাথে নেই না।

এমন না যে এই প্রথম কোন কিছুর রিভিশন করতে আমার সুপারভাইজর দেরী করছে। এরআগে তিন-চারবার তার নিজের দেওয়া ডেড-লাইনই সে ভঙ্গ করেছে। যাই হোক এই মনোমালিন্য ভাঙল সম্মেলনের শেষদিনের পার্টিতে।

সে বলল অক্সফোর্ডে ফিরে গিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে রিভিশন শেষ করে আমাকে ফেরত দিবে।
অক্সফোর্ডে ফিরে সেই রিভিশনের কাজ অবশেষে শেষ হল এপ্রিল মাসে। যাই হোক গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায় আমি এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করা বন্ধ করে দেই।

মে মাসে একটা পোস্টডক পজিশনের জন্য এপ্লাই করি। জুনের ইন্টারভিউয়ের পর আমাকে জানানো হয় ঐ পজিশনে অন্য একজনকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তাদের যেহেতু এক্সপেরিমেন্টাল ল্যাব একজন থিওরীটিশানকে বেতন দেওয়ার মত ফান্ডিং তাদের নেই।

এরপর আমি অন্য একটা গবেষণাপত্রের কাজ করতে থাকি। এই গবেষণা পত্রের বিষয়ঃ জীবের স্নায়ু তন্তের জটিলতা। আমি এখানে যুক্তি দেখাই যে স্নায়ুতন্ত্র পর্যবেক্ষণ করতে গেলে শুধু গঠনের জটিলতা দেখে বোঝা সম্ভব না যে স্নায়ুতন্ত্রের একটা অংশ কিভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করে। অনেক ক্ষেত্রে গাঠনিক দিক দিয়ে জটিল হলেও তারা যে গাণিতিক কর্ম বা এলগরিদম বাস্তবায়ন করে সেটা আসলে সরল গাণিতিক রূপে প্রকাশ করা সম্ভব।

এই গবেষণায় উদাহরণ হিসেবে কানের ভিতরের একটা অঙ্গ যাকে ককলিয়া বলে তাকে বেছে নেই আমার যুক্তি প্রমাণের জন্য। ককলিয়ার জন্য বিভিন্ন গাণিতিক মডেল তৈরি করে আমি দেখাই, যে মডেল ককলিয়ার জৈবিক গঠনের উপর ভিত্তি করে তৈরি সেই মডেল মস্তিষ্কের ক্রিয়া সমন্ধে যে ভবিষ্যতবাণী করে, তা অন্য একটি মডেল যেটা ককলিয়ার কার্যনীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি তা যে ভবিষ্যতবাণী করে, তার মতই।

এই কাজ করতে করতেই গ্রীষ্ম চলে আসে। আগষ্টে ল্যাবের এক বন্ধু আমার সাথে যৌথভাবে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। ওর অনেক পরীক্ষালব্ধ উপাত্ত থাকলেও সেটা বিশ্লেষণে ও আমার সাহায্য চায়।
একমাসের মধ্যে আমরা যৌথ ভাবে একটা গবেষণা প্রকল্প দাড় করিয়ে ফেলি। আমার সুপারভাইজর প্রকল্পের পরিকল্পণা শুনে বেশ উত্তেজিত ও খুশী হয়। তবে আমাদের দুজনেরই হাতে এত কাজ যে ২০২০ সালের আগে সেই প্রকল্পের কাজ শুরু করা সম্ভব না।

সেপ্টেম্বরে আমি একটা ইমেইল পাই। যে পোস্টডক পজিশন থেকে এর আগে রিজেক্টেক হয়েছিলাম তারা আমার সাথে কথা বলতে চায়। তারা আমাকে একটা প্রজেক্ট দাঁড়া করাতে বলে। আইডিয়া পছন্দ হলে তারা আমাকে ফান্ড করবে। গত কয়েক মাসে সেই আইডিয়া দাঁড় করিয়েছি। ২০২০ এর দ্বিতীয় সপ্তাহে তাদের সামনে আমার পরিকল্পনা উপস্থাপন করব।

এরমধ্যে ককলিয়া নিয়ে করা গবেষণাপত্রটির কাজ শেষ করে ফেলি। ডিসেম্বর মাসের প্রারম্ভে গবেষণাপত্রটি জমা দিয়েছি একটি জার্নালে। এখন রিভিয়ের কাজ চলছে। ক্রিসমাসের বন্ধের সময় অবসর কাটিয়েছি।

গতকাল থেকে ল্যাবে যাওয়া শুরু করেছি। এখন আমার পিএইচডি এর শেষ গবেষণাপত্রটি লেখা বাকি। যেটার বিষয় বস্তু, প্রানীর মস্তিষ্ক থেকে প্রানী যে শব্দ শুনছে তার অতীত ও ভবিষ্যত ডিকোড করা। এই প্রকল্পের কাজই করছিলাম বছরের শুরুর দিকে সম্মেলনে উপস্থাপনার জন্য।

তবে এই বছর গবেষণাই যে শুধু করেছি তা কিন্তু নয়। নিয়মিত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছি, অক্সফোর্ডের তিন’তিনটি বলে গিয়েছি, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছি এবং শরীরের যত্ন নিয়েছি। অনেক ধরণের নতুন খাবার খেয়েছি। অনেক নতুন পদের রান্না করা শিখেছি। প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে দৌড়াতে গিয়েছে। দৌড়ানো সম্ভব না হলে লম্বা দৈঘ্যের পদব্রজে বের হয়েছি। ইয়োগা করা ছিল নিত্য-নৈমত্তিক। গ্রীষ্মে সাঁতার কেটেছি অনেক দিন।

এই বছর যুক্তরাজ্যের ভিতর অনেক শহরে ঘোরা হয়েছে – যেমন, পোর্টমাউথ, সাউথহ্যাম্পটন, ব্রিস্টল, বাথ, নটিংহাম, স্ট্রাটফোর্ড আপন এভন, লেমিংটন স্পা, গোরিং ও স্ট্রিথলী, কভেন্ট্রি এবং গ্লাসগো। যুক্তরাজ্যের বাইরে সুইডেনের স্কটহোমে ঘুরতে গিয়েছি।

বেশ কিছু বই পড়া হয়েছে এ বছর। উল্লেখযোগ্য – ব্রেভ নিউ ওয়াল্ড। থমাস হেনরী হাক্সলীর নাতি আলডস হাক্সলী এর ১৯৩০ এর দশকে লেখা এই সায়েন্স ফিকশনে এমন এক সময়ের কথা লেখা হয়েছে যখন মানুষের জীবন প্রযুক্তি দ্বারা এতটাই নিয়ন্ত্রিত যে সেখানে সাধারণ আবেগ অনুভূতির কোন জায়গা নেই। সেই সময়ের মানুষ ‘সোমা’ নামক একধরণের ঔষধ সেবন করে নিজেদের সুখি করে যখন ইচ্ছা। সেক্সপিয়রের কয়েকটা বাক্যে ওই সময়কে বর্ণনা করা যায় এভাবে,
How amazing! How many wonderful creatures there are here! Mankind is so beautiful! Oh, what a wonderful new world, that has such people in it!

২০১৯ এর একটা সেরা মুহুর্ত ছিল যখন আমার ভাতিজি ঊর্বি রূপকথার জন্ম হল। আমি দেশে গিয়েছিলাম তাকে দেখতে। একদিকে সে ক্ষুদ্র, দুর্বল, এবং অসহায় একজন শিশু অন্যদিকে তার মধ্যেই ভবিষ্যের সমস্ত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। এই অনন্য পর্যবেক্ষণ আমার জন্য ছিল অন্যরকম এক উপলক্ষ্য।

বছর শেষে উপলব্দি গুলোকে তিনটি শব্দে ব্যাখ্যা করতে গেলে যা দাঁড়াবে তা হলঃ ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স। ২০১৯ এ কাজ ও জীবন দুটির ভারসাম্য ছিল বলেই এতো কঠিন সময়ও পিছন ফিরে তাকালে দেখি বছরের বেশিরভাগ দিন খুশি ছিলাম। সুখী ছিলাম। তাই ২০২০ কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য একদম প্রস্তত এখন।

সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

মঞ্জিলুর রহমান
- কিবল কলেজ, অক্সফোর্ড

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on FacebookTweet on TwitterPlus on Google+