শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেল ২০২০

গত কয়েকবছর ধরে ফেসবুক এবং আমার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে কিছুটা লেখালিখি করছি। প্রত্যেক বছরের প্রথম দিনেই আমি সাধারণত গত বছরের ঘটনাবলী নিয়ে একটা পোস্ট লিখি। এবারও তা করতে চেয়েছি। কিন্তু পিছন ফিরে তাকালে স্মরণীয় ঘটনার চেয়ে সংকটের বাহুল্যই বেশি চোখে পড়ে।

সংকটের কোন অভাব ছিল না ২০২০ সালে। একদিকে করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী অন্যদিকে আমার পিএইচডির ফান্ডিং শেষ হওয়া দুই মিলিয়ে বেশ কাঠখোড় পোড়াতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও বছরটা ভালয় ভালয় শেষ করতে পেরেছি এইটাই স্বস্তির বিষয়।


কোভিড-১৯

জানুয়ারী ২০২০ঃ বছরটা শুরু করেছি স্পেনের আন্দালুসিয়া ভ্রমণের মধ্য দিয়ে। ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মৃদু আবহাওয়া আর দারুণ ঝলমলে রোদে শীতের দিনগুলো বেশ ভালভাবেই কাটছিল। এরসাথে ছিল ঘোরাঘুরি আর খাবার দাবার - নানা ধরণের সামুদ্রিক মাছ, অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী, জলপাই আর কাজুবাদাম। স্পেনের খাবারের গুণগত মান যুক্তরাজ্যের খাবারের গুণগত মান থেকে অনেক ভাল। জীবন-যাপন আর আমোদ আহলাদের দিক থেকে ইউরোপের মূল ভুখণ্ডের লোকজন সবসময়ই বিলেতের থেকে এগিয়ে থাকে।

মালাগা, কর্ডোবা, গ্রানাডা আর সেভিয়ার পথে প্রান্তরে ঘুরে যখন অক্সফোর্ডে ফিরে আসলাম ততদিনে বিশ্ব গণমাধ্যমে এক ভাইরাসের কথা প্রচারিত হচ্ছে। চীনের উহান শহরে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরছে সেই ভাইরাস। ইউরোপের মানুষজন সেইভাবে এই ভাইরাসকে গা করছে না।

অক্সফোর্ডে ফিরে আমি কিছুটা চৈতন্য ফিরে ফেলাম। আমার পিএইচডি এর ফান্ডিং মার্চ পর্যন্ত। এরপরে অর্থ উপার্জন করতে না পারলে গাছতলায় থাকা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। তাই খরচ কমানোর জন্য বাসা পরিবর্তন করলাম যাতে বাসাভাড়ায় কিছু টাকা বাঁচে। কিন্তু নতুন বাসায় গিয়ে দেখি বাড়িওয়ালা আমাকে মিথ্যা বলেছে। এই বাসায় প্রকৃতপক্ষে দুইজনের বদলে প্রায় পাঁচজন মানুষ থাকে। সবাই পাকিস্তানি। মানুষ হিসেবে বেশ ভাল। আমাকে ভাই বলে। কিন্তু এত মানুষজনের ভীড়ে থাকা সম্ভব নয় তাই আমি আমার পুরনো বাসায় আবার ফেরত গেলাম।

মার্চ ২০২০ঃ অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে আমি কিছু চাকুরির জন্য আবেদন করেছি। কয়েকটাতে ইন্টারভিউয়ের আমন্ত্রণ পেয়েছি। একটা পোস্টডকের জন্য আমেরিকার একজন প্রফেসর বলল সে আমাকে চাকুরি অফার করতে চায় আমি যাব কিনা। আমি তখনও ঠিক করিনি যাব কিনা তবে বললাম আমার যাওয়ার ইচ্ছা বলেই তো জবে এপ্লাই করেছি। এরইমধ্যে একটা ইমেইল পেলাম একটা স্টার্ট আপ থেকে। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ট্রাফিক সিগনাল নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। আমাকে গবেষক হিসেবে নেওয়ার জন্য ইন্টারভিউ নিতে চায়। আমি হ্যাঁ বললাম। কিন্তু আলোচনা ও ইন্টারভিউ শেষে বোঝা গেল আমার জন্য তাদের পজিশনটা ঠিক নয়।

এরই মধ্যে টেলিভিশনে খবরে দেখলাম উহানের করোনা ভাইরাস ইতালিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপই ইউরোপ আমেরিকায় আতংক শুরু হয়ে গেল। সেই সপ্তাহান্তে আমার কার্ডিফ যাওয়ার কথা ছিল ভ্রমণের জন্য। ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সনাক্ত হওয়া শুরু  করল যুক্তরাজ্যে। তাই কার্ডিফ ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করে ফেললাম। পরের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি খারাপ হতে লাগল। ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়তে থাকল। প্রথমে সামাজিক দূরত্ব ও হাত ধোওয়া, এরপর বাসা থেকে কাজ করা, সবশেষে শুরু হল লকডাউন। বাড়ির বাইরে যাওয়া যাবে না। শুরুমাত্র জরুরী প্রয়োজন ও শরীর চর্চার জন্য বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে। আমি সরকারী নির্দেশ মোতাবেক বাড়িতে সময় যাপন করতে থাকলাম। ছাদে যাই, পার্কে যাই আর বই পড়ি।


করোনাকাস্ট

এপ্রিল ২০২০ঃ লকডাউন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই আমরা কয়েক বন্ধু (সামির, হাসান, আনিস এবং কচি) নিয়মিত আড্ডা দেওয়া শুরু করলাম অনলাইন ভিডিওর মাধ্যমে। একদিন আমি বন্ধুদেরকে প্রস্তাব দিলাম আমাদের আড্ডাগুলো ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে প্রচার করলে কেমন হয়। প্রথমে কেউ রাজি না হলেও ধীরে ধীরে সবাই রাজি হয়ে গেল। এভাবেই শুরু হল করোনাকাস্ট। করোনাভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে নতুন তথ্য ও গবেষণাগুলোকে আমরা তুলে ধরতে থাকলাম আলোচনার মাধ্যমে। এপ্রিল ও মে মাস জুরে অনেকগুলো পর্ব করা হয়েছিল করোনাকাস্টের। 


গবেষণা

জুন ২০২০ঃ মহামারীর কারণে পিএইচডির কোন কাজ হয়নি গত কয়েকমাসে। তাই লকডাউন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আবার কাজে মনোযোগ দেওয়া শুরু করলাম। এরইমধ্যে শহর থেকে দূরে গাছগাছালি পূর্ণ সুন্দর একটা বাসা খুঁজে বের করেছি। বসন্ত আর গ্রীষ্মের দিনগুলো এই বাসায় বসেই কাজ করতে থাকলাম। আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য কলেজের কাছে আবেদন করলাম। তারা বাড়তি কিছু ফান্ডিং দিতে রাজি হল।

অগাস্ট ২০২০ঃ গত কয়েকমাসের টানা পরিশ্রমে আমার একটি গবেষণাপত্রের রিভিশনের কাজ শেষ। জমা দিলাম। দুইটি চাকুরির অফার পেলাম। আমেরিকারটা এবং একটা স্টার্ট-আপে। কিছুদিনের মধ্যেই স্টার্ট-আপ বলল কাজ শুরু করে দিতে। আমার যেহেতু অর্থাভাব চলছিল তাই পার্ট-টাইম কাজ শুরু করে দিলাম।

সেপ্টেম্বর ২০২০ঃ যুক্তরাজ্যে গ্রীষ্মকাল শেষ। শরতের আমেজ শুরু হয়ে গেলে। এরই মধ্যে আমার স্টার্ট বলল আমি যেন অক্টোবর থেকে অফিসে যাওয়া শুরু করি। এতদিন বাসা থেকে কাজ করছিলাম। তাদের অফিস ইংল্যান্ডের একটি ছোট শহর (টাউন - কিন্তু সিটি নয়) লাফবরহতে। সেপ্টেম্বরের একদিন সেখানে আমার নতুন অফিস দেখতে চলে গেলাম। অফিস দেখে একটা বাসা ঠিক করে চলে আসলাম সেখানে অক্টোবরে উঠার জন্য।


চাকরি

অক্টোবর ২০২০ঃ লাফবরহতে চলে এসেছি অফিস করার জন্য। পরিকল্পনা হচ্ছে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই কাজ চালিয়ে যাওয়া, আমেরিকার ভিসার জন্য আবেদন করা এবং ভিসা পেলে প্রথমে বাংলাদেশে যাওয়া আর ফিরে এসে আমেরিকা চলে যাওয়া। পিএইচডি এর থিসিস জমা দিয়ে দিব এই ফাঁকে। কিন্তু ভিসা অফিসে যোগাযোগ করার পর জানতে পারলাম আমেরিকার দূতাবাস ভিসার সাক্ষাতকার দিচ্ছে না। তাই পূর্বের পরিকল্পনা বাতিল করলাম।

নভেম্বর ২০২০ঃ আবারও করোনা মহামারীর প্রকোপ বাড়তে শুরু করায় দ্বিতীয় লকডাউন দেওয়া হল। আমি বাসা থেকে কাজ করা শুরু করলাম। পিএইচডি এর থিসিস জমা দেওয়ার তারিখ পিছিয়ে দিলাম।

ডিসেম্বর ২০২০ঃ লাফবরহতে আমার কোন বন্ধু-বান্ধব নেই। অফিসে যাওয়া নেই। বাসায় থাকতে থাকতে ভয়াবহ বিষন্নতা গ্রাস করতে থাকল আমাকে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে আবারও অক্সফোর্ডে ফিরে আসলাম। এই বাসার পিছনে বাগান আর তারপর নদী। বাগানে কাঠবিড়ালি, পাখি আর হরিণেরা বেড়াতে আসে মাঝে মধ্যে। লাফবরহ থেকে আমার সব জিনিসপত্র আনিনি এখনও। জানুযায়িতে যাব সেগুলো নিয়ে আসতে।


পরিকল্পনা

পুরো ২০২০ সাল ছিল পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার বছর। তাই নতুন করে তেমন পরিকল্পনা করছি না। কিন্তু কিছুদিন আগে বন্ধু এলেক্সের সাথে হাঁটতে বের হলে ও বলল, চল আমরা দুই জনে মিলে কিছু একটা করি। আমি একটা প্রকল্পের আইডিয়া বললাম। এখন সেটা নিয়ে কাজ করা শুরু হতে পারে। তবে আমি বেশি প্রেসার দিচ্ছি না নিজেকে। প্রত্যাশা কম কিভাবে করতে হয় সেটা মহামারীর একবছর হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিয়েছে আমাকে। ২০২১ এ থিসিস জমা দিব। পোস্টডক শুরু করব। সাথে কোন একটা সাইড প্রজেক্ট হিসেবে একটা স্টার্ট-আপ শুরু করার ইচ্ছা আছে। হলে হবে, না হলে নাই। এত বড় একটা মহামারী পার করতে পেরেছি এটাই অনেক বড় একটা সার্থকতা।


শিক্ষা

মহামারীর একবছরে শিক্ষণীয় জিনিসের কোন অভাব নাই। সবচেয়ে বড় যেটা শিখেছি তা হল বিপদ কখন আসে তা বলা কঠিন। তাই বিপদের প্রস্তুতি রাখা উচিত সব সময়। এই সময়ে আমি অর্থ জমানোর গুরুত্ব বুঝতে শিখেছি। একটা ভাল বাসা যেখানে আরামদায়কভাবে প্রশান্তির সাথে কাজ করা যায় তার গুরুত্ব বুঝতে শিখেছি। সাথে সাথে বুঝতে শিখেছি কাছের মানুষগুলোর সাথে সম্পর্কের গুরুত্ব।

 

মঞ্জিলুর রহমান

- কিবল কলেজ, অক্সফোর্ড

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on FacebookTweet on TwitterPlus on Google+