বই পড়া

আমার স্কুল জীবন পার করেছি কুড়িগ্রামে। ছোট শহর হওয়ায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে বিষয়ে পড়ার ব্যবস্থা সেখানে খুবই কম ছিল। ইন্টারনেট তখনও সেভাবে আসেনি। আর বোর্ড বইয়ের বাইরের কোন বই কুড়িগ্রামে পাওয়া কঠিন ছিল। তারপরও স্কুলের পড়াশুনা চুকিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের একটা সাবজেক্ট পড়ে এখন বিশ্ববিখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউরোসায়েন্সে পিএইচডি করছি; এর অনেকটা কৃতিত্ব আমার জীবনে পড়া বইগুলোর।


যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন আমাদের স্কুলের এক ম্যাডাম স্কুলের পুরাতন লাইব্রেরীটি সংস্কার করার উদ্যোগ নেন। আমিও সেই উদ্যোগে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করি। লাইব্রেরীতে কাজ করার সুবাদে ম্যাডাম আমাদের একটা বিশেষ সুবিধা দিলেন। অন্যরা যেখানে লাইব্রেরী থেকে একটা বই ধার নিতে পারে সেখানে আমিসহ অন্য ভলান্টিয়াররা একবারে পাঁচ থেকে দশটা বই নিতে পারি।

আমি এই সুযোগটাকে কাজে লাগালাম। নিয়মিত স্কুল লাইব্রেরী থেকে বই ধার নেওয়া শুরু করলাম। দিন-রাত শুধু বই পড়ি।

কিছুদিনের মধ্যেই আমি একটা বিষয় খেয়াল করলাম। আমি বেশিরভাগ সময় নিজের অজান্তেই খুঁজে খুঁজে বিজ্ঞানের ধার করি। অন্য যেসব বই লাইব্রেরী থেকে নেই, তার বিশেরভাগ হয় কিছুদূর পড়েই পড়া বাদ দেই আর নাহয় খুব বেশি উপভোগ করি না। এই যেমন- একবার এক রাশিয়ান লেখকের বাংলায় অনুদিত একটি বই নিলাম লাইব্রেরী থেকে। পড়া শুরু করলাম। প্রথম গল্পটা ছিল একটা রাশিয়ান প্রেম কাহিনী। কিন্তু সেই প্রেম কাহিনীর আগা-গোড়া কোনটাই বুঝতে পারলাম না। তাই বইটি পড়া বাদ দিলাম। আরও অনেক বইয়ের ক্ষেত্রেও এরকম হল।

ভাল লাগুক আর না লাগুক অনেক বইই পড়তাম। অনেক সময় নতুন কিছু জানার জন্য, অনেক সময় নিজের উপর জোর করে। তবে বিজ্ঞানের বইগুলো মুগ্ধ হয়ে পড়তাম (নাকি নিজের কাছেই মুগ্ধ হওয়ার ভান করতাম!)। একটি বই পড়েছিলাম যেটায় যুগে যুগে বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারগুলোর কথা লিখা ছিল। এই যেমন- কিভাবে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ বের করা হল, কিভাবে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব বের করা হল এসব। আমার কাছে এইসব কে ম্যাজিকের চেয়ে কোন অংশে কম মনে হত না।

আর একটা বই পড়েছিলাম বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কে নিয়ে, বইয়ের নাম 'মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন'। বইয়ের লেখকের নাম মনে নেই। সেই বইয়ে আইস্টাইনের জীবনের সব মজার ঘটনা, তার ভায়োলিন বাজানো, প্রেম, ব্যক্তিগত জীবন ও সর্বোপরি তার থিওরী অব রিলেটিভিটি নিয়ে জানতে পারি। মনে হতে থাকল আইনস্টাইনের মত একটা জীবন পেলে মন্দ হত না।

ক্লাস নাইনে ভাইয়া স্টিফেন হকিংয়ের এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম (বাংলায় কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস) বইটি কিনে দেয়। শুরুতে ভয়াবহ কঠিন লাগলেও ধীরে ধীরে বইয়ের মূল কথাগুলো বুঝতে পারি। আর এই বইটি পড়ার পরেই আমি বুঝতে পারি আমি আসলে জীবনে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে চাই। কারণ বিজ্ঞানের মাধ্যমেই মহাবিশ্বকে বোঝা সম্ভব।

আজ এতদিন পর পিছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারি একেকটা বই কিভাবে আমার চিন্তাজগতকে গড়ে তুলেছে। কিভাবে আমার জীবনের বেশিরভাগ ধারণাগুলো আমার পড়া বইগুলোর দ্বারা আবর্তিত।

এখনও কোন কিছু শিখতে গেলে আমি সাধারণত বই পড়ে শিখতে পছন্দ করি। লেকচার বা অনলাইন টিউটোরিয়াল ফলো করার অভ্যাস এখনও গড়ে তুলতে পারিনি। এতদিন পরেও তাই বইই আমার প্রধান শিক্ষক।

- কিবল কলেজ, অক্সফোর্ড

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on FacebookTweet on TwitterPlus on Google+