বৃষ্টি নিয়ে কাব্যিক ঢঙে এই কথাগুলো লিখেছিলাম সম্ভবত ২০১৪-১৫ সালের দিকে। আজকে হঠাৎ করে লেখাটা পড়ে মনে হল আগে কখনও আপলোড করা হয়নি। যদি আপলোড করেও থাকি আরেকবার পড়ে নিতে পারেন। অনুভূতিপ্রবণ একটা লেখা।
=o=
ছোটবেলাটা আমার গ্রামে কেটেছে। গ্রামের বেশিরভাগ দিনই ছিল খুব একঘেয়ে। করার তেমন কিছু থাকত না। প্রতিদিন পার হয়ে যেত খুব সাধারণ কিছু কাজে। বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়ে, স্কুলে গিয়ে, স্কুল থেকে ফিরে এসে, ঘরে বসে পড়াশুনা করে আর পড়ার ফাঁকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে। এভাবেই সময় কেটে যেত। তবে একদম আলাদা ছিল বর্ষার দিনগুলো।
বর্ষা এলেই একঘেয়ে জীবনে একটু ভিন্নতা চলে আসত। টিনের চালে ঝমঝম মূর্ছনায় বৃষ্টির গান সময়ের গতি একটু বাড়িয়ে দিত। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বিহীন অন্যান্য দিনের চেয়ে আলাদা এই দিনগুলোর জন্য তাই মুখিয়ে থাকতাম। কবে বৃষ্টি আসে। কবে খালি গায়ে একটু ছোটাছুটি করি। কবে বৃষ্টি ভেজা মেটে রাস্তায় একটু স্লিপ দেই। বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকতাম পুরো বর্ষাকাল।
নারিকেল গাছের সাথে বৃষ্টির একটা আলাদা সম্পর্ক আছে। টিনের চালের উপর নারিকেল গাছ থাকলে সেখানে বৃষ্টির শব্দটা ভিন্ন হয়। মাঝে মাঝে জোরালো, মাঝে মাঝে ধীর। বাতাসের প্রবল বেগ নারিকেল পাতাগুলোকে টিনের সাথে ঝাঁপটা লাগায়। বারান্দার পাশে নারিকেল পাতা থাকলে একটা দৃশ্য চোখে পড়ে। পাতার ডগা বেয়ে চুইয়ে পরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি। এক, দুই এভাবে ফোঁটাগুলো গুনে গুনে সময় পার করে দেয়া যায়।
বর্ষার দিনে আশেপাশের লোকজন আমাদের বাইরের বারান্দায় চলে আসত। যে বারান্দার পাশে একটা নারিকেল গাছ আছে। আমাদের বাইরের বারান্দাটা একেবারে রাস্তার পাশে। কোন দরজা নেই, ফলে বৃষ্টির সময় পথচারীরা আশ্রয় নিতে পারে। অনেক লোক জড়ো হলে তারা গল্প-গুজব করতে পারে। হাসি-ঠাট্টায় তখন তাদের সময় পার হয়ে যায়।
এত মানুষ একসাথে দেখা ছিল আমার জন্য মজার ব্যপার। এমনকি উৎসব বললেও ভূল হবে না। আমি তাদেরকে গল্প-গুজব করতে শুনতাম। কারও কাছে হয়ত নারিকেল পাতা দিয়ে বাঁশি বানিয়ে নিতাম। আর বৃষ্টি দেখতাম। এভাবে কখন দিনের অনেকটাই চলে যেত টেরও পেতাম না।
আজও বৃষ্টি হচ্ছে। তবে আমি এখন গ্রামে নয় শহরে থাকি। এখন আর আগের মত বৃষ্টির কাছাকাছি যাওয়া হয়না। শহুরে জীবনে বর্ষায় গা বাঁচিয়ে চলি। কিন্তু তারপরও বৃষ্টি এখনও হৃদয়কে নাড়া দেয়। এখনও শুকনো শরীরে মন এক-আধটু আর্দ্র হয়। তখন মনের একাকীত্বগুলো বের হয়ে আসে। আমার কাছে বৃষ্টি হল পৃথিবীতে সব মানব মনের মিলিত কান্না।
বাস্তবে, অতৃপ্ত মনের সব মানুষ একজোট হয়ে অবিরাম কাঁদতে থাকলে কি হত, ভাবা যায়! এতে পৃথিবী পানিতে প্লাবিত না হলেও, দুঃখে প্লাবিত হতই। বৃষ্টির সময় সেই দুঃখের কিছুটা আঁচ হয়ত পাওয়া যায়।
দুঃখ আর ভালবাসা অবিচ্ছেদ্য। অতৃপ্তি থেকেই আসে ভালবাসা। পূর্ণতার আশায় বসে থাকে ভালবাসা পাগল লোকজন। বৃষ্টির ক্রন্দন অনুভব করায় সব অপূর্ণতা। বৃষ্টির সময় মানুষের মনও তাই অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশিই ভালবাসা প্রবণ হয়ে ওঠে। প্রিয়জনের কথা মনে করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। অথবা একটু একটু করে চোখের অশ্রু বর্ষণ করে বৃষ্টির পানির পরিমান বাড়ায়।
আমার মনেও আজ একটু আর্দ্রতা বিরাজ করছে। শুষ্ক মনে আবেগ নিয়ে এসেছে বৃষ্টি। নিজেকে রোবট নয়, মানুষ মনে হচ্ছে। বৃষ্টিই এই পরাবাস্তব জগতকে বাস্তবে নিয়ে এসেছে। তাই বৃষ্টির জন্য আমার ভালবাসা। অনেক অনেক ভালবাসা।