গত বছর নভেম্বরে প্যারিস শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে হামলা করেছিল আইএসের জঙ্গিরা। ঘটনার পরদিন আমার ফ্রান্সের বন্ধুকে জিঞ্জেস করেছিলাম এখন প্যারিসের অবস্থা কি? তোমার পরিবারের সবাই ঠিক আছে তো? ও বলেছিল, "আমার এক আত্মীয় মারা গেছে। তবে শহরের অবস্থা স্বাভাবিকই আছে। এমন হামলাতেও প্যারিসের লোকদের জীবনে কোন প্রভাব আসবে না। তারা আগের মতই আমোদ ফূর্তি করতে থাকবে। প্যারিস জানে জীবন কিভাবে যাপন করতে হয়।" আমি আবার জিঙ্গাস করেছিলাম, তুমি ও তোমার পরিবার কি এতে আতংকিত? ও তখন বলেছিল, "সন্ত্রাসিরা তো এটাই চায়। সবাইকে আতংকিত করতে। সুতরাং আমরা ভয় পাওয়া মানে তারা জিতে গেল। তাই ভয় পাওয়ার কোন মানে হয়না। এমন হামলার পরেও স্বাভাবিক জীবন চালিয়ে যাওয়াই তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার একমাত্র উপায়।" কথাটা একদম সত্যি। আমাদের দেশে জঙ্গি হামলার পরও একই কথা প্রযোজ্য।
তবে প্যারিসের হামলার সাথে ঢাকার হামলার কিছু গুণগত পার্থক্য আছে। যেমন প্যারিসের হামলাকারীরা ছিল অভিবাসী বা অন্য দেশের নাগরিক, আর ঢাকা হামলার সবাই বাংলাদেশী। প্যারিসে অতর্কিতে গোলাগুলি হলেও ঢাকার ক্ষেত্রে দেশীয় উপায়ে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশে এতদিন থেকে চলে আসা এক একটা খুনের সাথে এই ঘটনার অনেক মিল আছে। এই ঘটনা হঠাত করে ঘটেনি। দীর্ঘদিন ধরে এর উপাদান আমাদের সমাজেই ছিল, আর তা আস্তে আস্তে বড় হয়েছে এবং হচ্ছে।
অনেকে বলছে হত্যাকারীদের পরিবার নেই, ধর্ম নেই, দেশ নেই। কিন্তু এই কথা সত্য নয়। বরং এটা হচ্ছে কঠিন সত্য থেকে পালানোর একধরণের উপায়। তবে আসল সত্য থেকে পালানোর যতই চেষ্টা করা হোক সত্য সত্যই থাকবে। আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি হত্যাকারীদের পরিবার কারা, তাদের ধর্ম কি এবং তাদের দেশ কোনটা। এখন কথা হচ্ছে এই তিনটা জিনিসের কোনটার বা একাধিকটার গলদের কারণেই তারা হয়ত অপরাধীতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং সবকিছু অস্বীকার না করে আমাদের বের করতে হবে গলদ কোথায় আর সেটা কিভাবে ঠিক করা যায়।
এর আগে ব্লগারদের খুন করা হলে অনেক নিষ্পাপ মানুষও সেটাকে সমর্থন করত। বলত "তারা ইসলামের বিরুদ্ধে কটুক্তি করছে তাই তাদের উচিৎ শিক্ষা হইছে"। এরপর অন্য ধর্মের লোকদের খুন করা হলে, তখন বলা হত "কাফিরদের মারছে ঠিকই করছে"। এখন কিন্তু এরা মুসলমানদেরও মারতেছে। তাই যারা এদের সমর্থন করে অথবা সবকিছু অস্বীকার করে বলে এদের পরিবার, দেশ বা ধর্ম কিছু নাই, এরা আকাশ থেকে ভেসে এসেছে, তাদের বলছি, এরপর আপনার পালা। ইউ আর গোয়িং টু বি দ্যা নেক্সট। সুতরাং গলদগুলোকে অস্বীকার না করে সংশোধন করার চেষ্টা করুন। আর সংশোধনের প্রথম ধাপ গলদ স্বীকার করা।
আমাদের সমাজের একটা বিষয় সবসময়ই আমাকে কষ্ট দেয়। আমরা মজা করার সকল উপকরণকেই মোটামুটি পাপ মনে করি। যেমন- খেলাধূলা করা, গান করা ইত্যাদি। উঠতি বয়সের ছেলেপেলেরা যদি সুস্থ উপায়ে নিজেদের প্রকাশ করার সুযোগ না পায় তাহলে তারা অসুস্থ উপায়ে নিজেদের হিরো বানানোর চেষ্টা করবে এতে অভাক হওয়ার কিছু নেই। তবে হ্যাঁ একটা নষ্ট সমাজেরও সবাই জঙ্গি হবে না। তাই কেউ যদি বলে এত ছেলে থাকতে ঐ কয়জনই কেন জঙ্গি হল তাদের যুক্তি ভ্রান্ত। আমাদের সমাজ আমাদের শেখায়, জীবনে পড়াশুনা করে চাকরি বাকরি করে টাকা উপার্জন করাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করি তখন, ফুটবল টুর্নামেন্টের ম্যাচ খেলার জন্যও আমাদের ডিপার্মেন্ট থেকে ছুটি দেওয়া হত না। কারণ শিক্ষকরা মনে করত খেলা-ধূলা মানে সময়ের অপচয়। ছাত্রদের একমাত্র কাজ পড়ালেখা করা। তো সেই ছাত্ররা কিছুটা স্বাধীনতা পেলেই পড়াশুনার বাইরে কি করা যায় সেটা খুঁজতে থাকবে। হতে পারে সেটা সাধারণ কিছু, অথবা জঙ্গিবাদের মত অসাধারণ কিছু।