রহস্যঘেরা মানবী

রাত ১০টা। ড্রয়ং রুমেই ঘুমিয়ে পড়েছিল রুহান।

ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর ক্লান্ত লাগছে খুব। বিকালে আধাঘন্টার বেশি ঘুমালে ওর সমস্যা হয়। খুবই অবসাদ লাগে। ঘুম থেকে ওঠার পর আর কিছু করতে ইচ্ছা করে না।

দিনটা একটু অন্যরকম ছিল ওর জন্য। শুধু মোবাইল সিম রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কিছুই করা হয়নি।
ক্ষুধা লেগেছে। ক্লান্তি আর ক্ষুধায় বায়োমেট্রিক হতাশাটুকু এখন আর নেই।


রান্নাঘরে গিয়ে সে খাওয়ারমত কিছু পেল না। বাইরে গিয়ে খেতে হবে, ভাবল ও।

বকশী বাজারে একটা কাচ্চি বিরিয়ানীর দোকান আছে। ওখানকার খাবারের স্বাদ ভাল। যদিও তেল একটু বেশি দেয়। দোকানটার নাম মনে পরছে না। একবারই গিয়েছিল ওখানে। তবে জিপিএস ডিভাইসটা থাকায় সুবিধা হয়েছে। রুহান সব সময় এটি চালু করে রাখে ফলে যেখানেই যায় সেখানকার লোকেশন রেকর্ড করা থাকে। যন্ত্রটি সেই তথ্য সাথে সাথে তার বাসার কম্পিউটার সার্ভারে পাঠিয়ে দেয়। ফলে পুরাতন জিপিএস ডাটা ঘাটলেই বুঝতে পারবে বকশীবাজারের কোন দোকানে সে এক ঘন্টার বেশি সময় ধরে অবস্থান করছিল, সেই দোকানেই যেতে হবে।

সাস্থ্যকর না হলেও আজকের রাতে বিরিয়ানী খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল রুহান। ঢাকার মানুষ নিয়মিতই কাচ্চি খায়, সে সুপারহিরো হোক অথবা সাধারণ কেউ। গত একমাস নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে কোন বাজে খাবার খায়নি সে। তবে আজকের মুড আবার চনমনে করতে মশলাদার দেশি খাবারের কোন বিকল্প নেই।
দেরী না করে নিজের মোটর বাইকে করে সে চলে গেল কাচ্চি খেতে। ভালই হল খাওয়াটা। কাচ্চির সাথে বোরহানী। একটু লেবুও চিপে দিয়েছিল কাচ্চির উপরে। এত খেল যে খাওয়া শেষে হাঁসফাঁস করতে লাগল।

নিজেকে একটু স্বস্তি দিতে রাতের বেলা নির্জন লালবাগ কেল্লায় একটু হেঁটে বেড়ানোর ইচ্চা হল ওর। কেল্লার পাশে লালবাগ চাঁদ তারা মসজিদের সামনে বাইকটি রেখে চলে গেল কেল্লার সীমান্ত প্রাচীরের সামনে। রাত হয়ে গেছে তাই কেল্লার প্রবেশপথ এখন দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নিরুপায় হয়ে প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে ভিতরে ঢুকতে হল। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল কেল্লার দক্ষিণ প্রাচীরের দিকে। এখানে একটা উঁচু জায়গা আছে যেটা অতীতে রুফটপ গার্ডেন ছিল। সেখানে গিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পরল সে। জ্যোৎস্নাভরা আকাশ দেখে ভরপেট খাওয়ার যন্ত্রণার কথা একদম ভুলে গেল।

আকাশ দেখতে দেখতে সময়ের খেয়াল ছিলা না রুহানের। এবার সে ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বারটা বেজে গেছে। বাসায় ফিরতে হবে। অপরাধীরা রাত বারটার পর সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই এই সময়টা সুপারহিরোদের সবচেয়ে ব্যস্ত কাটাতে হয়।

ফেরার সময় পরী বিবির মাজারের কাছে আসতেই ও থমকে গেল। মাজারের ভিতর কেউ একজন বসে আছে। দেখতে তার মোটেও ভুল হয় নি। একটা দরজার তালায় ঝটকা দিল ও। সুপারহিরোর পেশীর শক্তিতে তালা ভেঙ্গে গেল। সাথে সাথে ভিতরে ঢুকে পরল ও। কিন্তু শব্দ পেয়ে মাজারের ভিতর বসে থাকা ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ দৌড় দিল। অন্য একটি দরজা হয়ত আগে থেকে খুলে রেখেছিল, সেই পথে পালিয়ে গেল। অবশ্য সুপারমালের তাকে ধরে ফেলতে সময় লাগল মোটে ৩০ সেকেন্ড।

এইবার অবাক হওয়ার পালা। ব্যক্তিটি একজন নারী এবং কাকতালীয়ভাবে বসুন্ধরা সিটি ও মহাখালীতে যে মেয়েকে সুপারমাল উদ্ধার করেছিল সেই নারী। মেয়েটির একহাত এখনও ছেড়ে দেয় নি। এই অবস্থায়ই তাকে জিজ্ঞেস করল, “এত রাতে এখানে কি করছেন?”
মেয়েটি উত্তর দিল, “আমি এখানেই থাকি”।
“মানে?” “মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?”
“মাথা খারাপ হবে কেন? আমার জন্মই হয়েছে এখানে। জন্মের পর থেকে এখানেই থাকি।”
“প্লিজ উল্টা পাল্টা কথা বলা বন্ধ করেন। আমার হাতে সময় বেশি নেই। কাজে যেতে হবে।”
“আপনার তাড়া থাকলে তো আমার কথা শুনতে পারবেন না। আমার গল্প অনেক দীর্ঘ।”
“আচ্ছা আগে আপনার নাম পরিচয় বলেন তো।”
“আমার নাম তুলি বিবি। আমি পরী বিবির মেয়ে।”
“এইভাবে মিথ্যা বলতে থাকলে কিন্তু আমি আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুলিশে দিব।”
“তাহলে আমিও আপনার সব কথা পুলিশকে বলে দিব যে এনিই হচ্ছে সুপারমাল।”

এইবারে আসল ঝামেলা বুঝতে পারল তমাল। ঘটনার আকস্মিকতায় সুপারহিরোর পোশাক পরতে ভুলে গিয়েছে সে। আর এখানে তো এসেছিল হালকা মেজাজে একটু হাঁটা-হাঁটি করতে কিন্তু এখানে এসে এই ঝামেলায় পরতে হবে কে জানত। কিন্তু ভুল যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে, এখন থেকে সাবধান থাকবে হবে। বাইরে বেরুলেই সুপারহিরো পোশাক পরে বের হতে হবে। কিন্তু তার আগে এই তুলি বিবির কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। নিশ্চয় সে মানসিক রোগী। সুস্থ কোন মানুষ নিজেকে পরী বিবির মেয়ে দাবী করতে পারে না।

পরী বিবি ছিল বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানের মেয়ে। সেই শায়েস্তা খান যার সময় এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত! ১৬৭০ সালের কাছাকাছি সময় সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছেলে মুহম্মদ আজম ঢাকায় আসেন। ঢাকাকে কিছুদিন আগে বাংলার রাজধানী করা হয়েছে। ঢাকার ঐশ্বর্য বাড়াতে মুহম্মদ আজম লালবাগ কেল্লা নির্মাণের পরিকল্পনা নেন এবং ১৬৭৮ সালে কেল্লার কাজ শুরু হয়। জনশ্রুতি আছে মুহাম্মদ আজমের সাথে পরী বিবির বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল এবং বিয়ে হওয়ার কথা ছিল খুব শীঘ্রই। কিন্তু এই সময় মারাঠাদের সাথে মুঘলদের যুদ্ধ লাগে। মুহম্মদ আজমকে তার বাবা তখন কেন্দ্রে তলব করেন। ফলে থেমে যায় লালবাগ কেল্লার কাজ। কিন্তু শায়েস্তা খান আবারো কেল্লার কাজ শুরু করেন। এর কিছুদিন পর পরীবিবি মারা যায়। তাকে কবর দেয়া হয় লালবাগ কেল্লায়। এ ঘটনায় শায়েস্তা খান খুব ভেঙ্গে পরেন। পরে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নেয়া হলে শায়েস্তা খান ঢাকা ত্যাগ করে সেখানে চলে যান।

এখন এই তুলি বিবি দাবী করছে সে পরী বিবির মেয়ে যেখানে প্রকৃতপক্ষে পরী বিবির কখনও বিয়েই হয়নি। কোন মানসিক ডাক্তারকে পরিচিত আছে কিনা এটা ভাবতে লাগল তমাল।
তুলির দিকে ফিরে বলল, “আপনার উপর নিশ্চয় কোন কারণে অনেক মানসিক ধকল গেছে। আমার সাথে চলেন একটু বিশ্রাম নিবেন। তারপর কাল সকালে আপনাকে আমার পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”

এবারে তুলি একটু রেগে গেল, “আপনার কি মনে হয় আমি মানসিক রোগী? তাহলে শোনেন আমার ঘটনা। পরী বিবির স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নি। মা অন্তঃসত্তা ছিল, তার পেটে ছিল মুহম্মদ আজমের বাচ্চা। বিয়ে ছাড়া গর্ভধারণ করায় মা এটা সবার কাছ থেকে গোপন করে। তিনি নানু শায়েস্তা খান এবং অন্যদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতেন। তবে প্রসব বেদনা শুরু হলে তিনি আর সহ্য করতে পারেননি। রাজকবিরাজের কাছে যান। রাজকবিরাজ তখন সেই ব্যপারটা গোপনে আমার নানুকে জানিয়ে দেন তার সাগরেদ মারফত। নানু জন্মের সাথে সাথে আমাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে আদেশ দেন। আমাকে বিষ খাওয়ানো হয়ও। কিন্তু আমার মা তখন তার নিজের জীবন উতসর্গ করে আল্লাহর কাছে দুয়া করেন, সৃষ্টিকর্তা যেন তার নিজের জীবনের বিনিময়ে আমাকে জীবিত রাখেন। এরপর মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মা-মেয়ে আমাদের দু’জনকেই কবর দেওয়া হয় একই জায়গায়। কিন্তু সেই রাতেই আমার জীবন আবার ফিরে আসে। আমি কবরের ভিতর কাঁদতে থাকি। আমার কান্নার শব্দ শুনতে পায় পাশের মসজিদের ইমাম দরবেশ বাবা। তিনি আমাকে কবর থেকে তুলে উদ্ধার করেন এবং গোপনে নিজের কাছে রেখে আমাকে লালন-পালন করতে থাকেন। আমার বয়স যখন বারো তখন সবাই এই কেল্লা থেকে চলে যায়। শায়েস্তা খান যাওয়ার সময় নির্মাণ করে রেখে যায় এই পরী বিবির মাজার। এই জায়গাটি একদম পরিত্যক্ত হয়। এখানে মানুষ আসা একদম বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকেই আমি এখানে থাকি। বিশের পর আমার বয়স আর বাড়েনি। দরবেশ বাবা আমাকে বলেগিয়েছিলেন যে আমার মধ্যে সুপারহিরোইনের শক্তি আছে। কিন্তু সেই শক্তি এখনও সুপ্ত। আমাকে সেটা বের করে আনার জন্য কিছু একটা করতে হবে। সেটা কি আমি জানি না।”

তমাল বলল, “আমার বিশ্বাস হয়না”।

তুলি ওর মায়ের উর্দু ভাষায় লেখা চিঠিটি তমালকে দেখতে দিল। তমাল তাকে নিয়ে নিজের বাসায় আসল। তুলিকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে নিজের স্টাডিতে চলে গেল গেল ও। সাথে নিয়ে গেল তুলির দেখানো চিঠিটা। চিঠির কালি থেকে একটু তুলে নিয়ে ক্যামিক্যাল এনালাইসিস শুরু করে দিল ও। কার্বনের রেডিও আইসোটপরের রেকর্ডিং পরিমাপ করে বুঝতে পারল তুলি মিথ্যা বলেনি। এই চিঠির বয়স তিনশ বছরের কাছাকাছি।

এবার তুলিকে থাকার জন্য একটি ঘর দেখিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে আসল সে। ভাবতে লাগল একজন মানুষের পক্ষে কি আদৌ তিনশ বছর বেঁচে থাকা সম্ভব। কাল সকালে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিবের সাথে দেখা করতে যাবে সে। তিনি এবিষয়ে কিছু জানলে জানতেও পারেন। এ বিষয়ের সব রহস্য তাকে উদ্ধার করতেই হবে। তাছাড়া তুলিকে সুপারহিরোইন হিসেবে গড়ে তুলতে হলে জানতে হবে কিভাবে তার সুপ্ত শক্তি বের করে আনা যায়। দু’জনে মিলে একটা সুপার টিম তৈরি করবে তারা। টিমের একটি নামও মনে মনে ঠিক করে রাখল সে। সময় হলেই তুলিকে বলবে।

মঞ্জিলুর রহমান
কিবল কলেজ, অক্সফোর্ড

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on FacebookTweet on TwitterPlus on Google+