গবেষণাপত্রঃ গুজব বা হাইপের গতি প্রকৃতি নির্ধারণে গণিতের ব্যবহার

সুচনাঃ গুজবে কান দিয়ে চলা আমাদের সমাজের অনেক পুরাতন বিষয়। যখন একটা হাইপ ওঠে তখন সবাই সেদিকে ছোটে। কেউ যদি হাইপের বিপরীতে চলতে চায় তাকেও আটকে দেওয়া হয়। কেউ যুক্তির কথা বললে তার কথা কেউ শোনে না। এজন্য আমাদের দেশে কোন কিছু করতে গেলে হাইপের বিষয়টা বিশেষ মাথায় রাখতেই হয়। হাইপ বিষয়ে আরও বলার আগে এর সংজ্ঞা পরিষ্কার করা জরুরী। একটি ঘটনা হঠাত সংঘটিত হয়ে জনগণের মাঝে আলোচনার জন্ম দিয়ে আবার কিছুদিন পর বিস্মৃত হয়ে গেলে, তাকে হাইপ বলে। হাইপের একটা সমস্যা আছে। এর লং-টার্ম ভবিষ্যত খুবই অনিশ্চিত। হাইপ বেশিরভাগ সময় অপরিকল্পিতভাবে বাইচান্স হয়ে যায়। সাধারণত, কারও চিন্তা ভাবনায় একটি হাইপ গড়ে ওঠেনা। ট্রায়াল-ইরর করে করে হাইপগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। এই যেমন তনু হত্যার বিচার চেয়ে কিছুদিন আগে একটা হাইপ দেখা গেল। অন্য অনেক হত্যায় কোন হাইপ হয় নি। টাইমিংও বড় একটা ফ্যাক্টর। কোন ঘটনার ঠিক আগে অন্য কোন হাইপ ছিল কিনা তার উপর নির্ভর করে ঘটনাটি হাইপে পরিণত হবে কিনা। কোন হাইপের ঠিক কত পরে আর একটা হাইপ হবে তার উপর নির্ভর করে মূল হাইপটি কত স্থায়ী হবে। স্বাভাবিকভাবেই, তনুহত্যা বিচারের হাইপ এখন আর নাই। এসব পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে এবং সমাজে প্রচলিত কিছু নীতির উপর ভিত্তি করে আলোচ্য গবেষণাপত্রে হাইপের গাণিতিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হল।

ফলাফল ও ব্যাখ্যাঃ

হাইপ বিষয়ে দুই ধরণের সুত্র দেওয়া যায়।

ঘটনকালের সুত্রঃ হাইপের ঘটনকাল তার আগে ও পরে হওয়া অন্য হাইপের সময়কালের উপর নির্ভর করে। এই ঘটনকাল হাইপ শুরুর সময় থেকে পরবর্তী হাইপ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

তীব্রতার সুত্রঃ হাইপের তীব্রতা ঘটনার আকস্মিকতা, নতুনত্ব এবং আবেগতাড়নার উপর নির্ভর করে। উল্লেখ্য হাইপের আবেগতাড়না একটি এবস্ট্যাক্ট পরিমাণ। কোন সময়ে একটি হাইপ জনগণের আবেগে যত বেশি বা কম প্রভাব ফেলে তাকে হাইপের আবেগতাড়না বলে। এবিষয়ে একটি রেফারেন্স দেওয়া যায়। ইল নিউজ রানস ফাস্ট বা খারাপ খবর দ্রুত ছড়ায়। তারমানে খারাপ খববের আবেগতাড়না বেশি। আবেগতাড়না একটি জটিল রাশি। তাই খুব শীঘ্রই এর মান প্রকাশে আবেগতাড়নার মঞ্জিলুর স্কেল প্রকাশ করা হবে।

তীব্রতার মানের পরিবর্তন ব্যাখ্যায় গাণিতিক মডেলঃ তীব্রতার মান সময়ের সাথে সাথে এক্সপোনেনশিয়াল বা লজিস্টিক সমীকরণ অনুসারে পরিবর্তিত হয়। অন্য যেকোন লজিস্টিক মডেলের মত হাইপের তীব্রতার মানের পরিবর্তনে চারটি ফেজ বা দশা থাকে। প্রথম ফেজটিকে বলে ল্যাগ ফেজ, দ্বিতীয়টিকে বলে লগ বা এক্সপোনেনশিয়াল ফেজ, তৃতীয়টিকে বলে স্টেশনারী ফেজ আর চতুর্থটিকে বলে ডিক্লাইন বা হ্রাস ফেস। যাদের এই টার্মগুলো কঠিন মনে হচ্ছে তাদের জন্য সেগুলো আরও বিস্তারিত দেওয়া হল।

ল্যাগ ফেজঃ যেকোন হাইপের শুরুতেই একটা ল্যাগ ফেজ বা স্লথ দশা। এসময় হাইপের তীব্যতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। হাইপটি এসময় জনগণের মাঝে একটু একটু করে প্রচার পেতে শুরু করে এবং গুজব ছড়ানোর রসদ যোগায়। কিছু মানুষ হাইপ ছড়ানোর পিছনে পরিশ্রম করলে ল্যাগ ফেজের সময় কমে আসে এবং একটি ঘটনা দ্রুতই হাইপে পরিণত হয়।

লগ ফেজঃ ল্যাগ ফেজের পর হাইপের তীব্রতা একটা নির্দিষ্ট মানে পৌঁছালে হাইপের গতি সূচকীয় ভাবে বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। অর্থাৎ প্রথম একদিনে হাইপ দ্বিগুণ হলে পরের একদিনে হাইপ চারগুণ হয় এরপর আটগুণ এভাবে চলতে থাকে। অর্থাৎ ঐকিক নিয়মে বা যোগ করে ব্যপারটাকে প্রকাশ করা যায় না গূণণ বা সূচকের প্রয়োজন পড়ে। তীব্রতার যে মানে পৌছালে একটি ঘটনা হাইপে পরিণত হয় তাকে সূচন তীব্রতা বা থ্রেসহোল্ড তীব্রতা বলে।

স্টেশনারী ফেজঃ তবে সময়ের সাথে সাথে হাইপ দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও একসময় তার তীব্যতার মান তেমন আর বাড়ে না। অর্থাৎ তীব্রতার মান সর্বোচ্চ হয়ে যায়। হাইপের তীব্রতার বাড়ার বেগ স্লথ হওয়ার পিছনে বেশ কিছু বিষয় কাজ করে। প্রথমত অন্য কোন হাইপ শুরু হয়ে গেলে সেটা প্রথম হাইপের উপর ইনহিবিটরী বা ঋণাত্মক প্রভাক সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, মানুষের এনার্জি বা উত্তেজনা কমে আসতে থাকে।

ডিক্লাইন ফেজঃ এই পর্যায়ে এসে হাইপের তীব্রতা কমা শুরু করে এই একে ডিক্লাইন ফেস বা হ্রাস দশা বলে। হাইপ ছড়ানোর পিছনের মানুষের চেয়ে অন্য মানুষের অংশগ্রহন বৃদ্ধি, হাইপ চালানোর পিছনের মানুষদের উতসাহে ভাটা পরা এবং তাদের ভিতরে সমস্যা সৃষ্টি হওয়াকে এই ফেজের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

চিত্রে একটি লজিস্টিক মডেলের বিভিন্ন দশা দেখানো হয়েছে। সাথে সাথে এর পিছনে জড়িত গাণিতিক সমীকরণগুলোও দেখানো হয়েছে। ২নং সমীকরণ অনুসারে কোন সময়ে হাইপের তীব্রতা জানা থাকলে নির্দিষ্ট সময় পরে হাইপএর অবস্থা ক্যামন হবে তা জানা যায়। তবে এজন্য K এর মান জানা থাকতে হবে। অর্থাৎ মানের পরিবর্তনের ট্রেন্ডের একটা পরিমাপ সমীকরণে থাকতে হবে। যাই হোক বেশি গণিক লোকে পছন্দ করে না। তাই এইটুকুই যথেষ্ট।

এইধরণের মডেল প্রকৃতিতে সচরাচর দেখা যায়। যেমন- পুকুরে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি। কোন পুকুরে বাইরে থেকে নতুন করে কোন খাবার সরবরাহ না করে সেখানে মাছ ছেড়ে দিলে সাধারণত মাছের সংখ্যা লজিস্টিক মডেল অনুসরণ করে। প্রথমে মাছগুলো পুকুরের পরিবেশের সাথে খাপ খায় এবং তেমন বংশবৃদ্ধি করে না। এরপর তারা ডিম দেওয়া শুরু করে এবং বাচ্চা দেয়। মাছের সংখ্যা লগ স্কেল বা সূচকীয় হারে বাড়তে থাকে। তবে শীঘ্রই পুকুরে থাকা খাবারে টান পড়ে। এবং মাছ আর আগের মত বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। তখন তাদের সংখ্যা স্টেশনারী ফেজে থাকে। এরপর আরও সময় গেলে খাদ্যের অভাব অনেক পানিতে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাওয়া এবং অক্সিজেন কমে যাওয়ায় বেশিরভাগ মাছ মরে যায়। তবে ডিক্লাইন ফেজের পরেও একটি দুইটি মাছ ঐ পুকুরে থেকে যায় যারা বছরের বছর সেখানে বাঁচতে থাকে। যেকোন আন্দোলনের পর এমন কয়েকজন নেতা দেখা যায়।

কালচার প্লেটে ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি একই ধরণের মডেল অনুসরণ করে। উদ্ভিদ ও প্রাণী কোষকে দেহের বাইরে কালচার করলেও একই অবস্থা দেখা যায়।

উপসংহারঃ হাইপ ক্ষণস্থায়ী বিষয়। তবে এর চাল-চলন লজিস্টিক মডেল দ্বারা ব্যাক্যা করা যায়। তবে হাইপের পিছনে ছুটে লাভ হবে কিনা সেটা বলা কঠিন। একটি হাইপ সৃষ্টির জন্য শুরুতে পর্যাপ্ত মানুষের অংশগ্রহণ দরকার। এরপর সেটা অটো হয়ে যাবে। হাইপের পিছনে ক্রমাগত কাজ না করে গেলে হাইপ একসময় থেকে যাবে। বুদ্ধিমান সমাজের মানুষ হাইপে কম এবং বিবেচনায় কান বেশি দেয়। তাই সেখানে হাইপ তৈরি করা কঠিন। অন্যদিকে আমাদের সমাজে হাইপ তৈরি করা তুলনামূলক সহজ।

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on FacebookTweet on TwitterPlus on Google+