বাইরের জগত ও ভিতরের জগতঃ সত্য ও মিথ্যা

অন্য প্রাণীর থেকে মানুষের পার্থক্য হল, অন্য প্রাণীরা শুধু বাইরের জগতকে দেখে ও সেখানে বিচরণ করে। কিন্তু মানুষ কল্পণার মাধ্যমে নিজের ভিতরে আর একটা জগত তৈরি করে। এই বাইরের আর ভিতরের জগতের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে প্রতিনিয়ত।


মানুষের ভিতরের জগত বা মনন শুধু নিজের ভিতরেই বন্দী থাকে না। একে বের করা যায় নিজের ভিতর থেকে। প্রকাশ করা যায়। মানুষ এটা করতে পারে কারণ তার ভাষা আছে।

ভাষা ব্যবহার করে আমরা যা কিছু বলি তাতেই আমাদের ভিতরের জগতের পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা অনেক সময় এমন কিছুই বলি যা আমরা কখনও দেখিনি বা শুনিনি। অর্থাৎ যার কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই।

এভাবে ভাষা ব্যবহার করে আমরা যেমন সত্যকে তুলে ধরতে পারি তেমনি অনেক মিথ্যাও বানিয়ে বলতে পারি। এই মিথ্যা বলার ক্ষমতাকেই বলে কল্পণাশক্তি।

তবে সব মিথ্যা কিন্তু মিথ্যা নয়। অনেক মিথ্যা সত্যের চেয়েও শক্তিশালী হতে পারে। এমন অনেক মিথ্যার মধ্যে একটি বড় উদাহরণ হল- ভালোবাসা। প্রিয়জনের প্রতি মমত্ব অন্য প্রাণীরও আছে। কিন্তু মানুষই সম্ভবত একমাত্র প্রাণী যারা 'ভালোবাসা'র অনুভূতিকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়।

কাউকে যদি জিঞ্জাসা করা হয়। ভালোবাসা বলতে সে কি বোঝে। বিভিন্নজনের কাছ থেকে এই প্রশ্নের বিভিন্ন উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু একটা বিষয়ে সবাই হয়ত একমত, ভালোবাসা জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অনেকে বলবে ভালোবাসা হল একটা অনুভূতি। অনেকে বলবে ভালোবাসা মানে নির্স্বার্থ ভাবে অন্যের জন্য কাজ করা। কেউ হয়ত বলবে ভালোবাসা মানে হচ্ছে সুখ-আনন্দ। বিজ্ঞান বলে ভালোবাসা হল হরমোন ক্ষরণে মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কিন্তু শুধুই কি তাই? একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে ভালোবাসা শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে, আমরা ছোট বেলা থেকে এখন পর্যন্ত যা শিখেছি তার সবই। এর মধ্যে অনেক কিছুই একদম নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা। যেমন- আমরা বুঝি কেউ আমাদের ভালোবাসলে, সে আমাদের ভালো চায়। আর কেউ আমাদের ঘৃণা করলে সব সময় আমাদের খারাপ চায়। আমাদের খারাপ কিছু হলেই তাতে তাদের আনন্দ। এই ভাবে ভালোবাসা শব্দটির সাথে সাথে ঘৃণা শব্দটি চলে আসে। একটিকে বুঝলে আর একটি বোঝা যায়। ঘৃণা নিয়ে বেশি কথা বলতে গেলে মূল প্রসঙ্গ থেকে দূরে চলে যাব। তাই ভালোবাসার প্রসঙ্গেই ফিরে যাওয়া যাক।

ভালোবাসা বিষয়ে অনেক কিছু আমরা যেমন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি, তেমনি এমন অনেক কিছুও শিখেছি যা আমরা নিজের অভিজ্ঞতায় কখনও পাইনি, বরং অন্য কেউ আমাদের বলেছে। বা অন্য কোন মাধ্যম হতে শিখে নিয়েছি।

একদম ছোট বেলায় আমরা দেখি রুপকথার গল্পের রাজপুত্র আর রাজকন্যার জীবনের উদ্দেশ্যই হল প্রেম-ভালবাসা-বিয়ে। যখনই তাদের মিল হয়ে গেল, তারপর থেকে তারা সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে লাগল। এরপর একটু বড় হলে, নাটক, সিনেমায় দেখি নায়ক-নায়িকার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যও হল ভালবাসা। ভালোবাসার মানুষকে পেলেই হয়ে যায় 'হ্যাপি এন্ডিং'। এভাবে আমরা বড় হতে থাকি আর আমাদের অনেক গল্প শোনানো হয় যার অনেক কিছুই হয়ত বাস্তবে সম্ভব না।

সাথে সাথে চলতে থাকে বড় বড় কোম্পানির বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা। আরও আছে বিশেষ দিবস। যেমন- ভ্যালেন্টাইন ডে। সাম্প্রতিক কালে অনেক ছেলে মেয়েই হয়ত প্রেম শুরু করেছে, এই ভেবে যে, ভ্যালেন্টাইন ডে তে তার সব বন্ধুরা প্রেম করতে বের হলেও সে কেন সেটা করতে পারছে না।

এই কাল্পনিক ধারণাগুলো আমাদের নিজেদের অনেকটা জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে। তাই ভালোবাসা বলতে আমরা একদিকে যেমন বুঝি সুখ-আনন্দ, আত্মত্যাগ বা অনুভূতি। তেমনি অন্যদিকে, ভালোবাসা বলতে বুঝি- ক্যাম্পাসে কারও হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো, সায়েন্স লাইব্রেরীর পিছনে গিয়ে বসে থাকা, পুরান ঢাকায় ঘুরতে যাওয়া, জন্মদিনে পাগলামি করা, কিছুক্ষণ পরপর ফোন ফোন দিয়ে গান শোনানো, দু'জনে মিলে নিজের জগতে ডুবে থাকা, ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন, বন্ধুরা মিলে ঘটা করে প্রেমের এনিভার্সারি পালন ইত্যাদি। যদিও এর কোন কিছু না করলেও ভালোবাসা এতটুকু কমবে না, কিন্তু এগুলো ছাড়া আমাদের জীবন চলে? এগুলো না থাকলে জীবন কেমন যেন পানসে হয়ে যায়। আর অনেক ক্ষেত্রে প্রেমের মৌলিক ভিত্তিই হয়ে থাকে এগুলো।

আমি কিন্তু বলছিনা, ভালোবাসার অনুসঙ্গ গুলো কোন অংশেই আমাদের জীবনের জন্য খারাপ। কারণ ভালোবাসা না থাকলে আমাদের সমাজের বর্তমান সভ্য রূপই হয়ত থাকত না। বরং কল্পপনার মাধ্যমে তৈরি হওয়া ধারণাগুলোর কারণেই আমরা মানুষ। আমাদের ভালোবাসা প্রকাশের ধরণ তাই অন্য প্রাণীর মত স্থূল নয়। 

এভাবে অনেক কাল্পনিক ধারণা আমাদের কাছে সত্যের চেয়েও বেশি সত্য হয়ে ওঠে। কারণ ওই যে, আমরা আমাদের নিজেদের জগতকে নিজেদের মত করে রাঙিয়ে নিতে পারি।

মজার ব্যপার হল, আমরা শুধু নিজের ভিতরের জগতেই বিচরণ করি না। বরং আশেপাশের অন্য মানুষের জগতেও বিচরণ করি। তার কারণেই একজনের তৈরি ভ্যালেন্টাইন ডে'র ধারণা অন্য সবার ভিতরের জগতে প্রবেশ করে। ব্যপারটা অনেকটা একসাথে একই স্বপ্ন দেখার মত। এটা সম্ভব হয় ভাষার কারণে। কারণ ভাষা দিয়ে আমরা যেমন- সত্য বলি, তেমনি সত্যটাকে মাঝে মাঝে বদলে একটু মিথ্যা বলি। এভাবেই তৈরি হয় নতুন ধারণা। সত্যকে আমুল বদলে দিলে সেটাকে বলে 'মিথ্যা', আর সত্যকে একটু বদলে বিশ্বাসযোগ্য করে বললে সেটাকে বলে 'সৃজনশীলতা'। প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূণ আহমেদ এই কারণেই এত নাম করেছেন। কারণ, উনি ডাহা মিথ্যা বিষয়কেও বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাই তার তৈরি করা গল্প অনেকের কাছে অতিরিক্ত 'কল্পণাপ্রবণতা' মনে হলেও অনেকের কাছেই তা জীবনের অবলম্বন। অনেক বেকার তরুণই গরম রোদে ঢাকার রাস্তায় হাঁটার সময় হয়ত স্বপ্ন দেখে হঠাৎ কোন সময় বড়লোক এক তরুণী গাড়ি থামিয়ে তার গাড়িতে তাকে তুলে নিবে। ভালোবাসাকে জড়িয়ে থাকা ধারণাগুলো হুমায়ুন আহমেদের গল্পের মতই। অনেকের কাছেই তা ভাবালুলতা। আর অনেকের কাছেই জীবন চলার পাথেও।

মানুষ তার ভিতরের জগতে শুধু ভালোবাসার মত অনুভূতির ধারণাই সৃষ্টি করেনা, সাথে সাথে এমন অনেক ধারণা সৃষ্টি করে যেগুলো কিনা এক একটি সত্ত্বা। যেমন- দেশ, জাতি ও দেশপ্রেম। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশকে আমরা বিভিন্ন দেশ বলি। বাংলাদেশ বললেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে লাল-সবুজের পতাকা, দেশের মানচিত্র, সুজলা-সুফলা গ্রাম আর নদী। তবে এর চেয়েও যেটা বেশি প্রকটভাবে উঠে আসে সেটা হল, এক ধরণের আপন অনুভূতি। বাংলাদেশ মানে আমার দেশ। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই আমরা দেখব এই ধারণাগুলো আমাদের নিজেদের তৈরি। বাংলাদেশের মাটির কোথাও বাংলাদেশ কথাটা লেখা নেই। আমাদের গায়ের কোথাও বাঙালি কথাটা লেখা নেই। কিন্তু আমরা নিজেদের দেশের কথা ভাবলে বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারিনা। আমরাদের এই পুরো ভাবনাটাই আছে আমাদের নিজেদের মনের ভিতর। আমাদের সবার ভিতরের জগতে যেহেতু এই কমন ধারণাটা আছে, তাই আমাদের নিজের তৈরি করা বাংলাদেশ ধারণাটা সত্যের চেয়েও বেশি সত্য। আমরা এর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত। কারণ আমরা জানি বাংলাদেশ না থাকলে আমাদের অস্তিত্বও থাকে না। অন্য দেশের ক্ষেত্রেও তাই।

এইভাবে নিজের জগতে থাকা ধারণাগুলো দিয়ে মানুষ গড়ে তোলে দেশ, দেশের সংবিধান, আইন - আদালত ইত্যাদি। আমরা সবাই জানি সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে হবে। এটা সবাই মিলে আমরা বিশ্বাস করি। এমন না যে পৃথিবীর সব দেশের সংবিধান একই রকম। কিন্তু আমরা জানি আমাদের সংবিধানকে রক্ষা করতে হবে। এতে যখন তখন হাত দেওয়া যাবে না। যদিও আমাদের দেশে সংবিধানকে একটু বেশিই কাটা-ছেড়া করা হয়েছে। কিন্তু যে দেশ তা করেনি তারা তত বেশি স্থিতিশীল থেকে এবং উন্নতি করেছে।

তারমানে মানুষের তৈরি করা ধারণাগুলো (মিথ্যাগুলোকে) রক্ষা করলে অনেক সময় সমাজের উপকার হয়। অনেক সময় অপকারও হয়। যেমন- আমরা সবাই কিছু কিছু কুসংস্কারে বিশ্বাস করি। গ্রামে গেলে প্রায়ই শোনা যায়, কাউকে ভূত ধরেছে। এই ধরণের বিশ্বাস আবার ক্ষতিকর। মিথ্যা বলার ক্ষমতা বা কল্পণাশক্তিকে ভাল কাজে যেমন লাগানো যায়, খারাপ কাজেও তেমনি লাগানো যায়।

এইযে আমরা একটা ধারণা তৈরি করতে পারি, তারপর সেই ধারণার জগতে সবাই মিলে বসবাস করতে পারি, তার কারণ, প্রথমেই বলেছিলাম, আমরা নিজেদের ভিতর এমন একটা জগত তৈরি করতে পারি বাইরের জগতের সাথে যার কোন মিল নেই। ভাষা ব্যবহার করে সেই জগতের ধারণা ছড়িয়ে দিতে পারি অন্যান্যদের মাঝে। আর সবাই মিলে সেই জগতে বসবাস করতে পারি যার বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সেটাই বাস্তবতা।

মঞ্জিলুর রহমান
কিবল কলেজ, অক্সফোর্ড

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on FacebookTweet on TwitterPlus on Google+