পিএইচডি ইন্টারভিউ/ বিসিএস ভাইভার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তোলা

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিসিএস লিখিত পরীক্ষা দিয়ে ঐ মাসেই ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। এরপর নতুন দেশে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে বেশ ব্যস্ত হয়ে পরি। বেশ পরিশ্রম করছিলাম ঐ সময়টায়।


 বাসার বাইরে একা একা থাকার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ঘরের কাজ থেকে রান্না-বান্না সবকিছু নিজে করতে হত। এর সাথে ছিল নিয়মিত ক্লাস। ভবিষ্যতে কার সাথে রিসার্চ করব তাঁর জন্য বিভিন্ন প্রফসরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করাও শুরু করেছিলাম ঐ সময়ই। ক্লাস লেকচারের পাশাপাশি করছিলাম পিএইচডি এর আবেদন। সব কিছু মিলে একদম নাভিশ্বাস অবস্থা। এরসাথে যোগ হয়েছিল দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় রিলেশনশিপ ব্রেক আপ। প্রাক্তন প্রেমিকাকে বার বার ফোন দিয়েও সে না ধরলে অনেক ভেঙ্গে পরি।

প্রশ্ন হতে পারে ইন্টারভিউ/ ভাইভার প্রস্তুতি নিয়ে বলতে গিয়ে এই সব ব্যক্তিগত কথা কেন বলছি। এর কারণ এই যে, ঐ সময়টায় আমার মানসিক অবস্থা ছিল একেবারে দূর্বিসহ। আর এমন মানসিক অবস্থায় ইন্টারভিউ/ ভাইভার জন্য দরকারী সবচেয়ে জরুরী বিষয়টায় আমি আমার মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেটা হল আত্মবিশ্বাস বা কনফিডেন্স।

তাই ভাইভার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই আত্মবিশ্বাসটা খুঁজে পাওয়া। কিন্তু শত চেষ্টা করেও, নিজেকে চিয়ার আপ করার মত অনেক কাজ করেও সেই আগের মত আত্মবিশ্বাসী হতে পারছিলাম না। সেইজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম জীবনের এই নতুন অভিজ্ঞতাকে নতুন ভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। আত্মবিশ্বাসী না হওয়া গেলেও প্রাকটিস করে করে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। দরকার হলে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী দেখানোর প্রাকটিস করতে হবে।

জীবনে এই প্রথমবারের মত আমি অনুভব করলাম চনমনে আর খুশি থাকা এত সহজ না। যেহেতু ভেতর থেকে চনমনে আর খুশি নই তাই শেখা দরকার ছিল কিভাবে অন্তত দেখানো যায় আমি চনমনে আছি।
বলে নেওয়া প্রয়োজন, ২০১৬ সালের জানুয়ারী মাসেই তিনটি পিএইচডি প্রোগ্রামের ইন্টারভিউ এর অফার পাই। দুইটি অক্সফোর্ড আর একটি ক্যাম্ব্রিজ থেকে। এই ইন্টারভিউগুলোর প্রস্তুতি কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে বিসিএস ভাইভা দেই। এই লেখায় মূলত ঐ সময়ে দেয়া এই চারটি ইন্টারভিউয়ের জন্য আমি কিভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম এবং সেগুলো থেকে নিজে কি শিখেছি সেটা বলার চেষ্টা করব।

যেকোন ইন্টারভিউয়ের ব্যপারে প্রথম চিন্তা হয় ড্রেস নিয়ে। আমিও চিন্তিত ছিলাম। তবে ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে এবং অন্যান্যদের অভিজ্ঞতা থেকে শুনলাম সায়েন্সসের পিএইচডি ইন্টারভিউয়ে সেটাই পড়া উচিৎ যেটা পড়তে নিজের ভালো লাগে। অক্সফোর্ডে এক দুইমাস থাকায় অবশ্য বুঝে গিয়েছিলাম এখানে কাজের ক্ষেত্রে সবাই ক্যাজুয়াল পোশাক পরে আর ডিনারে যাওয়ার সময় ফরমাল পোশাক পরে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম স্যুট পরব না।

প্রথম পিএইচডি এর ইন্টারভিউ এর জন্য আমি রীতিমত রিহার্সেল করা শুরু করি আমার সুপারভাইজার এর সাথে। এই সময় আমার সুপারভাইজার আমার ব্যপারে কয়েকটা বিষয় খেয়াল করেন। এর মধ্যে একটা ছিল আমাকে কোন প্রশ্ন করলেই আমি এমন একটা ভাব করি যেন আমাকে কেউ এটাক করেছে। আর একটা ছিল আমি কথা বলার সময় নিজের দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা থেকে সরে যাই।

বাসায় এসে আমি ভাবতে থাকি আসলেই তো। কেউ প্রশ্ন করছে তারমানে সে একটা কিছু জানতে চাচ্ছে। এটাকে অস্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার তো কিছু নাই। এখান থেকেই শিখি কেউ প্রশ্ন করলে তাকে ধন্যবাদ দিতে। কেউ ভাল প্রশ্ন করলে তাকে বলতে, ভেরী গুড কোয়েশ্চেন। এর সাথে প্রাকটিস করতে থাকি কিভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়। আর বসলে কিভাবে একই জায়গায় থেকে সবার দিকে আই-কন্টাক্ট করে কথা বলতে হয়।

এইভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে আবার পরেরদিন ভাইভার রিহার্সাল শুরু করি। কিন্তু সুপারভাইজারদের কারোরই মন মত হয় না। অবশ্য তারা এত ভদ্র মানুষ যে কেউ ই বলেনা আমি খারাপ করছি। বলে আরও উন্নতির জায়গা আছে। আমার মেইন সুপারভাইজার আমাকে বলে টেনশন করো না। চলো আমরা আলাদা আলোচনা করে বের করি কিভাবে তোমার ইন্টারভিউটাকে ভালো করা যায়। এভাবে দিনের পর দিনের পরিশ্রমে দারুণ একটা ডেমো ইন্টারভিউ দাড় করানো হয়। কিন্তু দারুণ প্রস্তুতিই যে শেষ কথা নয় সেটা বুঝি আরও পরে।

ইন্টারভিউয়ের দিন আসে। আমি ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখি বাকি অনেকেই স্যুট পরে পরিপাটি হয়ে এসেছে। আমি একটা সাদা শার্টের উপর সোয়েটার পরে গেছি। তারপর প্রস্তুতি অনুযায়ী ইন্টারভিউ দিলাম। ইন্টারভিউ শেষে একটা কথাই মনে হল আর একটু কম প্রাকটিস করা উচিৎ ছিল। কারণ এই ইন্টারভিউয়ে, যেকোন প্রশ্ন শোনার সাথেই সাথেই আমি মনে করার চেষ্টা করছিলাম সেই প্রশ্নের উত্তরে কি প্রাকটিস করে এসেছি। আর একটা ব্যপার হল, আমাকে কোন প্রশ্ন করলেই সেটার উত্তর প্রাকটিস করে আসা উত্তরের কাছাকাছি দিয়ে থেমে যাচ্ছিলাম। তখন আমার আর ইন্টারভিউয়ারদের মধ্যে একটা অপ্রস্তুত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছিল। কেউ কোন কথা খুঁজে পাচ্ছেনা এমন একটা অবস্থা আরকি।

প্রথম ইন্টারভিউ থেকে থেকে নেওয়া শিক্ষা কাজে লাগে দ্বিতীয় ইন্টারভিউয়ে। সেখানে একটা প্রশ্ন করে পরের প্রশ্ন না করা পর্যন্ত আমি কথা বলতে থাকি। তাতে দ্বিতীয় ইন্টারভিউটা প্রথমটার চেয়ে অনেক ভাল হয়।

দ্বিতীয় পিএইচডি ইন্টারভিউয়ের আগেই বিসিএস লিখিত এর রেজাল্ট হয়। পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলে সাথে সাথেই দেশে যাওয়ার প্লেনের টিকেট কেটে ফেলি।

দেশে যাওয়ার আগে দ্বিতীয় ইন্টারভিউটি দিতে যাই। এবার কোন রিহার্সাল নাই। শুধু সুপারভাইজারের সাথে রিসার্চ প্রপোজাল নিয়ে একবার আলোচনা করি। কিন্তু এই ইন্টারভিউয়ের দিন পুরাই ড্যাম কেয়ার থাকি।

এবারে শুধু একটা শার্ট পরেই চলে যাই। আশেপাশের অনেকেই এবারও স্যুট পরে এসেছে। তবে আমি মনে প্রাণে নিজেকে বলতে থাকি আমি যেমন তেমন ভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করব। ওদের ভাল লাগলে আমার ড্রেস দেখে ভাল লাগবে না আবার কথা শুনেই ভাল লাগবে। আর কেউ ড্রেস দেখে আমাকে জাজ করলে তাদের সাথে আমি গবেষণার কাজ করতে চাই না। অন্য কাজ হলে একটা কথা ছিল।

এইসব ভাবতে ভাবতেই ইন্টারভিউয়ে ডাক পরে আমার। ঐ রুমে ঢুকে আমি সবাইকে বলি, হ্যালো, হাউ আর উ ডুয়িং? তারাও আমার কথার উত্তর দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে। তারপর আমি জিজ্ঞেস করি, হোয়ার শুড আই সিট? তারা আমাকে টেবিলের এক প্রান্তের চেয়ারে বসতে বলে। আমি থ্যাংকস দিয়ে বসে পরি।

প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার অতীতের পড়াশুনা, গবেষণা সম্পর্কে বল এবং বল তোমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি? এই সময় প্রথম ইন্টারভিউয়ের থেকে শিক্ষা নেওয়ায় তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিলাম তারা পরবর্তী প্রশ্ন না করা পর্যন্ত কথা বলা থামাব না। আমি প্রথমে একটা স্বল্প ভূমিকা দিলাম আমি আগে কি করেছি এবং ভবিষ্যতে কি করতে চাই সেই প্রসঙ্গে। তারপর একটা দীর্ঘ ভাষণ দেওয়া শুরু করি এই বিষয়ে। কিছুক্ষণ পরে একজন ইন্টারভিউয়ার আমাকে থামিয়ে দেয়। বলে, শুধু আপনি লেকচার দিবেন আমরা শুনে যাব তার চেয়ে বরং আমরা একটা একটা করে প্রশ্ন করি আর আপনি উত্তর দেন। আমি বুঝে যাই এই ইণ্টারভিউটা আমার কন্ট্রোলে চলে এসেছে।

এরপর তারা প্রশ্ন করতে থাকে আর আমি উত্তর করতে থাকি। আর উত্তর শেষ করি এমন জায়গায় যাতে তারা এমন প্রশ্ন করতে বাধ্য হয় যেটা আমি চাই তারা আমাকে করুক। এইটাই প্রথম আর দ্বিতীয় ইন্টারভিউয়ের গুণগত পার্থক্য। প্রথম ইন্টারভিউয়ে আমার কোন কন্ট্রোল ছিল না। ইন্টারভিউ বোর্ড লিড দিয়েছে আর আমি তাদের ফলো করেছি। কিন্তু দ্বিতীয় ইন্টারভিউ ছিল পুরোই আমার কন্ট্রোলে।

ফলাফলও পেয়ে যাই হাতে হাতে। দ্বিতীয় ইন্টারভিউয়ের র‍্যাংকিং এ আমাকে দ্বিতীয় অবস্থানে আমাকে রাখা হয়। যেখানে প্রথম ইন্টারভিউয়ে আমাকে রাখা হয় দশম অবস্থানে।

ক্যামব্রীজের পিএইচডি ইন্টারভিউ অবশ্য খুব খারাপ হয়। আমি প্রত্যেকটা প্রশ্নেরই ভুল ভাল উত্তর দেই। কারণ রিসার্চ প্রপোজাল যে বিষয়ে লিখেছিলাম সেই বিষয় আমি নিজেই পরিষ্কারভাবে বুঝি না। আর কোন প্রস্তুতিও নেই নাই ইন্টারভিউয়ের জন্য। ঘুম থেকে উঠে হঠাত মনে হয়েছে পিএইচডি এর ইন্টারভিউ। আর সেই সুপারভাইজারের সাথে কাজ করার তেমন ইচ্ছাও ছিল না। এই থেকে একটা শিক্ষা পাই, একেবারে প্রস্তুতি না নেওয়া ইন্টারভিউয়ের জন্য ভাল নয়।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১১ই ফেব্রুয়ারী লন্ডন থেকে ঢাকায় উড়ে যাই বিসিএসের ভাইভা দিতে। দেশের মাটিতে পা রেখেই মনটা হালকা হয়ে যায়। ব্রিটেনের কনকনে শীত থেকে ঢাকার ফুরফুরে বাতাসে গিয়ে গত কয়েকমাসের মন খারাপ অবস্থাটা একেবারেই উবে যায়। এতই আনন্দে ছিলাম যে বিসিএস ভাইভার চিন্তা বাদ দিয়ে বন্ধু-বান্ধব আর প্রিয় মানুষদের সাথে ঘোরাঘুরি করে ভাইভার আগের দিনগুলো পার করে দিলাম। অবশেষে ভাইভার দিন আসলে পিএইচডি এর ইন্টারভিউ থেকে নেওয়া শিক্ষাগুলো কাজে লাগিয়ে নির্ভারভাবে ভাইভা দেই। শুধু একটাই পার্থক্য বিসিএসের ভাইভাই স্যুট টাই পরে পরিপাটি হয়ে গিয়েছিলাম।

শেষ করার আগে ভাইভা বা ইন্টারভিউ বিষয়ে কয়েকটি টিপসের কথা বলবঃ
১। ভাইভার আগে যতটুকু প্রয়োজন ততোটুকু প্রস্তুতি নেওয়াই ভাল। বেশি বা কম প্রস্তুতি কোনটাই ভাল নয়।
২। যেকোন প্রশ্নের উত্তরই এককথায় না দিয়ে বিশ্লেষণাত্মকভাবে দেওয়া ভাল।
৩। ড্রেস চয়েস নিজের ব্যক্তিত্ব ও সংশ্লিষ্ট পেশার ড্রেস কোড অনুযায়ী হওয়া উচিৎ।
৪। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, ইন্টারভিউ বা ভাইভাকে নিজের কন্ট্রোলে নিতে হবে। এমনভাবে কথা বলতে হবে যাতে সেই কথার লেজ ধরেই পরবর্তীতে নিজের পছন্দের প্রশ্ন করতেই ইন্টারভিউ/ভাইভা বোর্ড বাধ্য হয়।

মঞ্জিলুর রহমান
সামারটাউন, অক্সফোর্ড

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on FacebookTweet on TwitterPlus on Google+