ডোপামিন ও সুখের অনুভূতি

একটা কথা আছে, না পাওয়া জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সবসময়ই বেশি। কোন কিছুর অপ্রাপ্তি সেই জিনিসের প্রতি চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু পেয়ে গেলে চাহিদা কমে যায়। এই রকম জিনিসের সংখ্যা কম নয়। যেমন- মিষ্টি, চকোলেট, টাকা এরকম আরও অনেক উদাহরণ আছে।
 
কিন্তু কেন এমন হয়?

এই বিষয়টি নির্ভর করে মস্তিষ্কের একটা বিষয়ের উপর। সেটা হল আমাদের মস্তিষ্ক সব জিনিসের একটা মূল্য নির্ধারণ করে। যে জিনিসের মূল্য বেশি তা প্রাপ্তির আনন্দও বেশি। তবে এই মূল্য বাস্তবের মূল্যের মত নয়। যেমন- চকোলেটের চেয়ে গাড়ির দাম অনেক বেশি হলেও একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে মস্তিষ্কের কাছে গাড়ির থেকে চকোলেটের মূল্য বেশি মনে হতে পারে।

এই মূল্য নির্ধারণের পিছনে মাথার যেকয়টি প্রক্রিয়া কাজ করে তার মধ্যে অন্যতম হল ডোপামিন রিওয়ার্ড সিস্টেম। একটা কিছু পাওয়ার পরে মানুষ নিজেকে রিওয়ার্ডেড বা আনন্দিত মনে করবে কিনা তা নির্ধারণ করা এই সিস্টেমের কাজ। ডোপামিনই মূলত একটা জিনিসের মূল্য কত তা সিগনাল দেয়। অর্থাৎ চকোলেটের জন্য যদি বেশি ডোপামিন ক্ষরিত হয় তাহলে চকোলেট খেয়ে আনন্দ বেশি হবে।

মজার ব্যপার হল, ডোপামিনের ক্ষরণ হয় চকোলেট বা গাড়ি পাওয়ার আগেই। অর্থাৎ, কোন কিছু পেয়ে যাওয়ার আগেই ডোপামিন সেটার মূল্য নির্ধারণ করে। এর মানে হল, ডোপামিন আনন্দের সংকেত দেয় না বরং আনন্দের পূর্বাভাসের সংকেত দেয়। আর এই সংকেতটা তৈরির জন্য মস্তিষ্ক যে হিসাব করে তাকে বলে রিওয়ার্ড প্রেডিকশন এরর। অর্থাৎ, একটা জিনিস না পেলে আপনি কতটা আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন ডোপামিন সেটার সংকেত দেয়। কিন্তু সেই জিনিস পেলে আপনি কতটা আনন্দিত হবে তার সংকেত দেয় না।

কোন জিনিস না পেলে আপনি কতটা আনন্দ বঞ্চিত হবেন সেই হিসাব করা হয় তিনটি বিষয়ের সমন্বয়েঃ ঐ জিনিসের প্রাপ্তিতে অতীতে কতটুকু আনন্দ পাওয়া গেছে, এখন আপনার কাছে ঐ জিনিসের প্রাপ্তটা কতটকু এবং আপনার আর কতটুকু ঐ জিনিস প্রয়োজন। উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরেন, চকোলেট প্রাপ্তিতে আপনার ভীষণ আনন্দ হয়। কিন্তু আপনি ইতোমধ্যেই যথেষ্ট চকোলেট খেয়ে ফেলেছেন। তাহলে চকোলেট আপনাকে যতটুকু আনন্দ দেয় আর আপনি চকোলেটের জন্য যতটুকু আনন্দিত আছেন এই সময় তার পার্থক্য খুবই কম। ফলে চকোলেট না খেলে আপনি তেমন একটা বঞ্চিত হবেন না। এইটাই রিওয়ার্ড প্রেডিকশন ইররঃ প্রেডিক্টেড রিওয়ার্ড - প্রেজেন্ট রিওয়ার্ড।

এই কারণেই অপ্রতুল জিনিসের মূল্য মানুষের কাছে বেশি। কারণ কোন জিনিস এভেইলেভল থাকলে তার রিওয়ার্ড প্রেডিকশন এরর শূন্য।

এই জন্য মানুষকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, সব সময় এভেইলেভল থাকি তো তাই সস্তা হয়ে গেছি না?

কিন্তু আনন্দের এই বিষয়ে দুঃখেরও ব্যপার আছে। কারণ এই ডোপামিন সিস্টেমই আবার বিভিন্ন আসক্তির ক্ষেত্রেও কাজ করে। যেমন মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি। মানুষ যেহেতু এইসব দ্রব্য সেবন করে আনন্দিত হয় তাই এগুলোর প্রতি আকর্ষণ থাকে। মাদকদ্রব্যগুলো সাধারণত সরাসরি ডোপামিন সিস্টেমের উপরই কাজ করে। রাসায়নিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করে। ফলে কেউ যখন মাদক নেয়া শুরু করে তখন সেই অভিজ্ঞতা তাকে অনেক বেশি আনন্দ দেয়। কিন্তু সমস্যা হয় মাদক নেয়ায় অভ্যস্থ হয়ে যাওয়ার পর।

মস্তিষ্কের একটা ব্যপার হল এটি খুব দ্রুত যেকোন পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়। একই ব্যাপার আনন্দের ক্ষেত্রেও কাজ করে। অর্থাৎ কেউ সব সময় আনন্দিত থাকলে তাতেই অভ্যস্থ হয়ে যায়। মস্তিষ্ক তখন সেটাকেই স্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে ধরে নেয়। এর ফলে সেই আনন্দ থেকে বিচ্যুতি ঘটলে মস্তিষ্ক পেইন বা কষ্টের সংকেত দেওয়া শুরু করে। তাই যেকোন আনন্দে অভ্যস্থ হয়ে গেলে সেটার অনুপস্থিতিতে মানুষ কষ্ট পায়। মাদক দ্রব্যের ক্ষেত্রেও তাই। মাদকে আসক্ত হয়ে গেলে সেটা না পেলে মানুষের কষ্ট হয়।

প্রাপ্তির শুরুতে একটা জিনিস থাকে আনন্দের বিষয়, কিন্তু প্রাপ্তিতে অভ্যস্থ হয়ে গেলে সেটাই হয়ে যায় কষ্টের বিষয়।

তাই, আনন্দে অভ্যস্থ না হওয়াই কি ভাল? তাও তো ভাল নয়। তাহলে আবার আপনি স্যাডিস্ট আর ডিপ্রেসড হয়ে যাবেন। তাহলে কোনটা ভাল? আসলে কোনটাই ভাল নয়। ভাল থাকার একটাই উপায়। আনন্দ আর কষ্টের ভারসাম্য। ভারসাম্য নষ্ট হলেই সমস্যা।

আশা করি সবার জীবন সুখ-দুঃখের মিশেলে ভালই কাটুক।

মঞ্জিলুর রহমান
সামারটাউন, অক্সফোর্ড

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on FacebookTweet on TwitterPlus on Google+