কুল গাছ (গল্প)

একটি জেলা শহরে বড় হয়েছে ওরা। রূপক আর মেঘলা। এইচএসসি শেষ করে এবছরই রূপক ঢাকা মেডিকেলে আর মেঘলা ভর্তি হয়েছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। একই শহরের হলেও ওদের তেমন একটা কথা-বার্তা ছিল না, যদিও দু'জনই একে অপরকে চিনত। কিন্তু ঢাকায় এসে কিভাবে কিভাবে যেন ওদের বন্ধুন্ত্ব হয়ে গেল। হয়ত একই শহর থেকে এসেছে বলে মনের টান থেকে, অথবা দু'জনেরই কোন একসময়ের সুপ্ত ইচ্ছার কারণে।

যাই হোক এখন ওদেরকে আলাদা করাই কঠিন। সারাদিন ফোনে কথা, দেখা করা এসব ওদের আর মোটেও অস্বাভাবিক লাগছে না। ওরা বোধহয় ভূলেই গেছে কিছুদিন আগেও ওদের কোন কথা বার্তা ছিল না।




আজ বিকেলে রূপকের মন ভাল নেই। বাড়ির জন্য মনটা কেমন করছে। এই সময় ফোনটা বেজে ওঠে। রিসিভ করে কানে দেয় সে, ওদিকে মেঘলার কন্ঠ, “শুনেছিস, সামনে একটা ছুটি আছে?”
ছুটির কথা শুনেই রূপকের মনটা লাফিয়ে ওঠে, “না তো। ইস কত দিন হল বাড়ি থেকে এসেছি।"
“হ্যা, চার মাস।"
“যাই হোক কবে থেকে ছুটি কিছু শুনেছিস নাকি?”
“বোধ হয় এক সপ্তাহ পরে। তবে সব মেডিকেলে কিনা জানি না।"

শেষ পর্যন্ত অবশ্য দু'জনেরই ছুটি হল। বাড়ি গেল তারা একই বাসে পাশাপাশি সিটে। অদ্ভুত বিষয় হল ওদের দু'জনের মত ওদের পরিবারের মধ্যেও খুব খাতির হয়ে গেছে। মেঘলার বাসা থেকেই ওকে বলা হয়েছে রূপকের সাথে বাড়ি ফিরতে।

বাড়িতে ফিরে প্রথম দিন মায়ের আদর, আর ঘুমে কেটে গেল রূপকের। বিকেলে ফোন করল মেঘাকে (মাঝে মাঝে মেঘলাকে সে ডাকে মেঘা), “বাড়ির সবাইকে পেয়ে আমার কথা দেখছি একেবারেই মনে নাই!”
“আপনার বোধহয় খুব মনে আছে!"
“ফোন তো আমিই আগে দিছি।"
“সব সময় তো আমিই দিই, একদিন তুই দিলি।"
“কাল প্লান কি?”
“কোন প্লান নাই। সারাদিন বাসায় থাকবো। একটা কাজ কর, তুই আমাদের বাসায় চলে আয়। কাল সারাদিন আড্ডা মারা যাবে।"
“বল কি খাওয়াবি?”
“আমাদের বাসার ছাদে একটা কুল আছে। কুল ধরছেও এবার অনেক। কুল খেতে পারিস।"
“আচ্ছা, আর কিছু না খাওয়ালে কুলই খাব।"

পরদিন বিকেলে মেঘলার বাসার ছাদে দু'জনকেই দেখা গেল। ছোট কুলগাছ, কুলে কুলে ভরা। গাছটা ছোট। এত ছোট যে রেলিঙে বসে বসেই কুল ছেড়া যায়।

ওরা গল্প করছে, হাসাহাসি করছে, মাঝে মাঝে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। হঠাৎ একজনের কোন একটা ইয়ার্কিতে একে অপরের পিছনে দৌড়াদৌড়ি করছে।

রূপক, "এই কুলটা এত টেস্টি। এরপর থেকে প্রতিদিন তোদের বাসায় আসতে হবে, কুল খেতে।"
মেঘলা, "আসবি।"

এরপর কারও কোন কথা নাই। রূপকের মাথায় একটা চিন্তা কাল থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে। এত দিন পর সে বাড়ি এসেছে। বাড়ির সবাইকে কাছে পেয়েও সারাদিনই মনটা কেমন কেমন করছিল। অথচ আজ তেমন হচ্ছে না। এর কারণ কি মিষ্টি কুল, নাকি কুল গাছের নিচে বসা এই মিষ্টি মেয়েটি। ওর ঘোর কাটল মেঘলার গলার আওয়াজে।

মেঘলা, “জানিস, কাল সারাদিন মনটা মোটেও ভাল ছিল না। আজ ছাদে আসার পর থেকে ভাল হয়ে গেছে।"

রূপক মনে মনে ভাবে, বোকা মেয়ে এটা ছাদের জন্য নয় ছাদে যার সাথে এসেছ তার জন্য।

অবশ্য সে বলে, “হুমম। তোদের ছাদ আর কুল গাছটা আসলেই দারুণ।”
"এই কুল গাছটা আমার খুব প্রিয়।", বলে মেঘলা।
“আমার মাঝে মাঝে মনে হয় গাছ হব।”
“গাছ? কি গাছ?”
“এই যেমন ধর কুল ঘাছ। সবাই কুল খেয়ে প্রশংসা করবে। তোর মত সুন্দরি কোন মেয়ে প্রতিদিন সকালে পানি ঢালবে।"
“হইছে আমাকে পাম দিতে হবে না।”
"আচ্ছা যা, তোর মত অসুন্দরি কোন মেয়েই পানি দিবে। মন খারাপ হলে আমার নিচে এসে বসবে। আর যে কথা কাউকে বলা যায়না তাও আমার পাশে এসে বিড়বিড় করবে।”
“তুই কুল গাছ হলে আমি তোর গোড়ায় লবণ ঢালব। আর শুধু পাতা ছিড়ব।”
“পাতা ছিড়লে আমি অবশ্য মাইণ্ড করব। আমার কুল কেউ খেলে ভালই লাগবে বোধ হয়।”

কিভাবে ছুটির দিনগুলো যে ফুরিয়ে যাচ্ছিল, কেউই টের পেল না। রূপক ধীরে ধীরে মেঘলার প্রতি অনেক বেশী দূর্বল হয়ে পড়ল। বন্ধ শেষ হওয়ার দুদিন আগে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, মেঘাকে বলবে মনের কথা। ও বুঝে গেছে মেঘাও ওকে অসম্ভব পছন্দ করে।

বিকেলে মেঘাকে ফোন দিল রূপক, “মেঘা, বাসায় আসছি, রেডি থাক। একটু বাইরে বের হব।”

মেঘলার মনটা নেচে উঠল যেন। ও নিজের ঘরে গিয়ে হালকা জলপাই রঙের জামাটা পড়ল। এটা রূপকের পছন্দে ওর সাথে গিয়ে কেনা। আজই প্রথম পড়ল ও।

মেঘলা অপেক্ষা করতে থাকে। ২০ মিনিট কেটে গেছে কিন্তু কুল গাছ আর আসে না। সেই দিনের কথার পর থকে মেঘলা রূপককে ক্ষেপায় কুল গাছ বলে। এখনও ও আসে না কেন। একটা ফোন করা যায়। কিন্তু সে ফোন দিল না। কারও জন্য অপেক্ষা করতে ভালোই লাগে।

সে উঠে যায় ছাদে। গিয়ে কুল গাছটার নিচে বসে। গাছটার কাছে আসলে মনে হয় একে কিছু বললে সেটা রূপকই শুনতে পাবে।

নিচে ফোনটা বাজছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে রূপক আসেনি। ও দৌড়ে নিচে গিয়ে ফোনটা ধরে। আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে। ফোনটা কানে দিতেই, একটি ছেলে বলে, “মেঘলা বলছেন?"
"হ্যাঁ"
"আমি রূপকের বন্ধু। বাইকে করে বের হয়ে রূপক আপনার বাসার কাছের মোড়টায় এক্সিডেন্ট করেছে। এখন হাসপাতালে।"

ক্ষণিকেই মেঘলার পুরো শরীর অবশ হয়ে আসে। মায়ের সাথে রওয়ানা দেয় হাসপালের দিকে।

কিছুক্ষন আগে রূপকের জন্য অপেক্ষা করতে কি ভীষণ ভাল লাগছি। তখন কি সে জানত ওর এই অপেক্ষা চিরজীবন অপেক্ষা হয়েই থাকবে?

রূপক আর বাঁচে নি। কিন্তু মেঘলা সেটা মেনে নিতে পারে না। কুল গাছটির কাছে গিয়ে সে গল্প করে। গাছটির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর কাউকে কখনও কুলের পাতা ছিড়তে দেয় না।

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on FacebookTweet on TwitterPlus on Google+